Sunday, November 29, 2009

ভূমিজ / মাহবুব লীলেন

...

বৃক্ষের কোনো মূল্য নেব না আমি

ঘরবাড়ি মাটি ঘটিবাটি স্বপ্ন সবকিছু নিলামে ওঠাও
তবু বৃক্ষের জন্য কোনো চাইব না দাম

আদিবাসী মানুষের মতো মাটি কামড়ে পড়ে থাক বৃক্ষ সকল
বৃক্ষের প্রযত্নেই আমি ঠিকানা বলব উদ্বাস্তু দিনে;
                    ওই যে। ওই যে গাছ দেখা যায় ওখানে আমার বাড়ি
                    আমার ভাইয়েরা এখনো ওখানে থাকে

ওই মাটির দাবিতে আমি ফিরে এসে ডাক দেবো বৃক্ষকে আবার;
                    আমি এসেছিরে ভাই
                    আমিও তোর মতো এ বাড়ির লোক

বৃক্ষরা থাক- বৃক্ষেরা বড়ো হোক এ মাটির কোলে
মাটি বেচে দিলেও বৃক্ষের মালিকানা রইলো আমার
...
২০০১.০৩.০৯

লিয়েন / মাহবুব লীলেন

...

পুষ্পিতা ফিরে এসে আবার ফিরে গেলে থেকে যায় বহু কামড়ের দাগ
মনের মেঝেতে পড়ে থাকে পড়ে-ফেলা পাঠ্য বইয়ের বিবর্ণ পাতা

এ জীবনে পুষ্পিতা ফিরবেন না আর

সমস্ত সূত্র যাচাই করে সব দায় তিনি শেষ করে গেছেন
বিদ্যালয় থেকে ভালবাসার সমস্ত ক্লাশ তুলে নিতে নিতে বলে গেছেন তিনি
ভালবাসা তোমার জন্য নয়। ভালবাসার মতো করে তৈরি করা হয়নি তোমাকে বাবুই
তুমি বন্ধুত্বের পাঠ নিয়ে পড়াশোনা করো;
অসুস্থ হলে তোমার জন্য ডাক্তার ডেকে দেবো আমি
মাঝে মাঝে সংবাদ নেব। বিশেষ দিনে তোমার জন্যও কিছু উপহার কিনব
                                                    আর...
তুমি ভালো থেকো। কষ্ট নিও না মনে

রিফরমেশন / মাহবুব লীলেন

...

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস নাকি মাঝে মাঝে কেটে ফেলা পায়েও চুলকানি অনুভব করতেন
আর চুলকাতে গিয়ে দেখতেন ওখানে পা নেই; কাঠের এক ডামি

হয়তোবা কেটে ফেলা পায়ে পুরনো কোনো মশার কামড় মনে হয়ে যেত তার; তিনি হাত
বাড়াতেন
এবং দেখতেন তার একটা পা নেই

আমাদেরও অন্তরে বহুকিছু ডামি করে নিয়েছি আমরা সৌন্দর্য ও সভ্যতার নামে
বহুকিছু ফেলা হযে গেছে ছেঁটে; বহু অঙ্গ বিকি হয়ে গেছে ভাত আর ভর্তার দামে
কিন্তু কোথাও আমাদের কোনো কামড়ের স্মৃতি নেই। কোন অবচেতন পিঁপড়াও আমাদের
মনে করিয়ে দেয় না আমরা কেউই এখন আর না আছি না পূর্ণ মানুষ- না সম্পূর্ণ বাঙাল

কেননা ইলিয়াসের পায়ে ছিল কাঠ; আর আমাদের হৃৎপিণ্ডে প্লাস্টিক- হৃদয়ে সিমেন্ট
...
২০০৫.০৮.২৩

কলঘরে যাওয়ার আগে / সিকদার আমিনুল হক

...

কলঘরে যাওয়ার আগে তুমি নিয়েছিলে তিরিশ মিনিট। একটা
একটা কবিতা লেখার সমবয়স্ক সময় তিরিশ মিনিটটাকে তুমি
ইলাস্টিকের মতো টানছো। ওদিকে আমি দেখছি কত সাবান
ফেনা হয়ে গলে গলে নরম আর বর্তুল ঘর্মাক্ত শরীর থেকে।

পরিচিতার গোসলের শব্দ ততো ভালো লাগে না। নিজেকে
মনে হয় বাইরে থাকা বকলেশ-বদ্ধ কুকুর; একজনের ইচ্ছার
কাছে বন্দী। কিন্তু যদি পরস্ত্রী হয়, ফর্সা গোলগাল স্বপ্নে দেখা
বউটা হয় পাশের বাড়ির। কিংবা ক্লাস নাইনে পড়া বেণী
ঝোলানো চড়ুইগন্ধ পনেরো বছরের পলা হতো...
মনে পড়ে জামা কাপড় নেই। ইয়ার্ডলি সাবান আর ঝুপঝুপ
করা মগ থেকে পানি পড়ার বিরক্তিকর শব্দ হতো, তাহলে ?...

ভালোবাসা মানে বিচ্ছিন্নতা / ত্রিদিব দস্তিদার

...

অর্থহীন তোমার খেদ-উক্তি সব জ্বালিয়ে দিল
আমার যা-কিছু বলার এবং লেখার উচ্চারণ
এখন ছাই হয়ে বাতাসে ভাসে
আর আমিও ভাসি শূন্যতার ভস্মিত অংশে
হঠাৎ কখনো যদি বৃষ্টি নামে
মাটিতে হয়তো পলি বাড়বে
তোমার মনেও আবার নতুন অঙ্কুর
সবুজ পাতারা দুলবে
হয়তো স্মৃতি-উলকির বাতাস
না-বলা কথা শুনতে চাইবে, না-লেখা কবিতার শব্দ
একতরফা চাপিয়ে দেয়া অভিযোগের ঘানি
গুনে গুনে রাত বাড়বে
পুনরাবৃত্তি হবে সকাল
হয়তো তোমার রোদ হবে কিছুটা উদ্বিগ্ন, কিছুটা ম্লান
এবং প্রশ্ন তুলবে অভিযোগ নিয়ে
তবে সকল অভিযোগই হবে উত্তরহীন, সময়-খ্যাত
এই বলে বিচ্ছিন্ন হবে সম্পর্ক এবং সময়
তারপর আবারও গতি অন্য এক পথ, চলমান।

আসলে ভালোবাসা সম্পর্কের চলমানতা
সময় সংহারে কখনো পথ হয় একা
ভালোবাসা মানে বিচ্ছিন্নতার জন্য তৈরি থাকা।
...

শেষ মুহূর্তের কবিতা / রেজাউদ্দিন স্টালিন

...

শেষ মুহূর্তে মিথ্যে লিখবো
আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়
প্রকৃতপক্ষে আমার মৃত্যুর জন্য তুমিই দায়ী

অসম্ভব ঘন কাঁচের ভেতর থেকে তোমাকে দেখতে
পাত্র ভর্তি পারদের ভেতর থেকে বিরল স্পর্শ করতে
স্বপ্নের ভেতরে একসাথে আকাশে-আকাশে শঙ্খচিল হতে

পৃথিবীর জন্যে একটা মৃত্যু তেমন কিছু নয়
কিন্তু মানুষের জন্যে একটা মৃত্যু সাংঘাতিক শূন্যতা
ঘাসের চোখ থেকে শিশির শুকিয়ে যাওয়ার মতো
সুর সৃষ্টিতে পরাজিত মার্সিয়াসের শরীর থেকে
চামড়া ছাড়িয়ে নেয়ার মতো
পেগাসাস পঙ্খীরাজের পেছনে একটা ডাসকে
লেলিয়ে দেয়ার মতো

বোঝাপড়া / মাহবুব লীলেন

...

ভালোবাসি বলেই তোকে এত দুঃখ দেই প্রতিদিন

আবেগের খোলস ভেঙ্গে সাংসারিক দাবি ও অধিকারে তোর কাছে যাই
ছেড়ে চলে আসি
     ফেলে চলে আসি

নেই প্রত্যাশা- নেই অভিমান
নেই জীবনে জীবন জড়ানো স্বপ্নের জাল
তবু কী অদ্ভুত জড়িয়ে থাকা; বৃক্ষ ও মাটিতে বটের লতানো শেকড়

ভালোবাসি বলেই ভালো না বেসেও কেটে যায বহুদিন
ভালবাসি বলেই ভালবাসার কথাটাই বলা হয় না তোকে
...
১৯৯৯.০৯.০৫

বন্দনাপর্ব / মাহবুব লীলেন

...

জুলিয়েট সে নয়
বারান্দায় দাঁড়ানোর বয়স তার নেই
সে থাকে ঘরে

কলায় বিশ্বস্ত আর কামে নিরাপদ ত্রিশোর্ধ্ব নারী সে
পেশাদারি কুশলে নাড়াতে জানে প্রেমে ও খেলায়
ঠিক ঠিক জানে সে কোনখানে চেপে দিলে বুক
দারুণ শীতে আমি আর উঠব না কেঁপে
কোনখানে ছুঁয়ে দিলে হাত আমিও ছড়াব আগুনের ফুল

সে কুমারী নয়
শরীরের ভয়ে স্বমেহনের অসহ্য দায় তার নেই
শরীরকে জানে সে সংসার ও স্বপ্নের মাপে
মন আর দেহ দিয়ে টেনে
মাটির গভীর থেকে সুখ তুলে এনে
সে জানে
ত্রিশোর্ধ্ব বয়সকে বেঁধে রাখতে শাড়ির সুতায়
...
২০০২.০২.১৫

মন্বন্তর / মাহবুব লীলেন

...

এই দুর্দান্ত বৃষ্টির দিনে কোথায় পুষ্পিতা তুমি
আমাকে বাদ দিয়ে কি তোমার শহরেও বৃষ্টি হয়
তুমি কি তাকে অনুমতি দাও তোমার শরীরে পড়ার

এই বেহায়া বৃষ্টির দিনে কাকে শোনাও তুমি বৃষ্টির সুর-
                     কাকে দেখাও ভেজা আগুনের ভাঁজ
বৃষ্টির কসম কেটে কাকে আজ তুমি নিজের শহরে ডাকো

আমি জানি আমি আর নই সে মানুষ এখন
তুমি কি এখন অন্য কারো রক্ত খাও পুষ্পিতা ?
...

ভুল প্রেমে কেটে গেছে তিরিশ বসন্ত / তসলিমা নাসরিন

...

ভুল প্রেমে কেটে গেছে তিরিশ বসন্ত, তবু
এখনো কেমন যেন হৃদয় টাটায়-
প্রতারক পুরুষেরা এখনো আঙুল ছুঁলে
পাথর শরীর বয়ে ঝরনার জল ঝরে।

এখনো কেমন যেন কল কল শব্দ শুনি
নির্জন বৈশাখে, মাঘ-চৈত্রে-
ভুল প্রেমে কেটে গেছে তিরিশ বসন্ত, তবু
বিশ্বাসের রোদে পুড়ে নিজেকে অঙ্গার করি।

প্রতারক পুরুষেরা একবার ডাকলেই
ভুলে যাই পেছনের সজল ভৈরবী
ভুলে যাই মেঘলা আকাশ, না-ফুরানো দীর্ঘ রাত।
একবার ডাকলেই
সব ভুলে পা বাড়াই নতুন ভুলের দিকে
একবার ভালোবাসলেই
সব ভুলে কেঁদে উঠি অমল বালিকা।

ভুল প্রেমে তিরিশ বছর গেল
সহস্র বছর যাবে আরো,
তবু বোধ হবে না নির্বোধ বালিকার।
...

গোলাপ ফোটাবো / হুমায়ুন আজাদ

...

ওষ্ঠ বাড়িয়ে দাও গোলাপ ফোটাবো,
বঙ্কিম গ্রীবা মেলো ঝরনা ছোটাবো।
যুগল পাহাড়ে পাবো অমৃতের স্বাদ,
জ্ব'লে যাবে দুই ঠোঁটে একজোড়া চাঁদ।
সুন্দরীর নৌকো ঢুকাবো বঙ্গোপসাগরে,
অতলে ডুববো উত্তাল আশ্বিনের ঝড়ে।
শিউলির বোঁটা থেকে চুষে নেবো রস,
এখনো আমার প্রিয় আঠারো বয়স।
তোমার পুষ্পের কলি মধুমদগন্ধময়,
সেখানে বিন্দু বিন্দু জমে আমার হৃদয়।
...

কদম ফুলের ইতিবৃত্ত / আল মাহমুদ

...

আমি তোমাকে কতবার বলেছি আমি বৃক্ষের মতো অনড় নই
তুমি যতবার ফিরে এসেছ ততবারই ভেবেছ
আমি কদমবৃক্ষ হয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকব
কিন্তু এখন দেখ আমি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকলেও
হয়ে গিয়েছি বৃক্ষের অধিক এক কম্পমান সত্তা
বাঁশি বাজিয়ে ফুঁ ধরেছি আর চতুর্দিক থেকে কেঁদে
উঠেছে রাধারা
আমি কি বলেছিলাম ঘর ভেঙে আমার কাছে এসো
আমি কি বলেছিলাম যমুনায় কলস ভাসিয়ে
         সিক্ত অঙ্গে কদমতলায় মিলিত হও ?
আমি তো বলিনি লাজ লজ্জা সংসার সম্পর্ক যমুনার জলে
                                 ভাসিয়ে দাও
আমি তো নদীর স্বভাব জানি স্রোত বুঝি কূল ভাঙা বুঝি
কিন্তু তোমাকে বুঝতে বাঁশিতে দেখ কতগুলো ছিদ্র
সব ছিদ্র থেকেই ফুঁ বেরোয়
আর আমার বুক থেকে রক্ত।
...

বৈশাখে তোমাকে ভালোবাসি / ওমর আলী

...

বৈশাখে আবার আমি তোমাকে ভালোবাসি।
স্বপ্নে চলে যাই আমার সুদূর ভেনিসে,
গণ্ডোলায় বসি মুখোমুখি সারারাত,
ধুয়ে যাচ্ছে পৃথিবী জ্যোৎস্নায়
ধুয়ে যাচ্ছি তুমি আর আমি।
ফিরে আসি, আবার আমরা ফিরে আসি চট্টগ্রামে,
কর্ণফুলীতে খুলে দিই একটি নতুন সাম্পান,
বৈঠা আমার হাতে আর তুমি দু'টো হাত
রেখেছো আমার দুই কাঁধে,
বাতাসে তোমার রাত্রি কালোচুলের বিপুল সুগন্ধ।
যুগল চাঁদের ছবি খুলে যায়
তোমার বুকে।

তোমার জন্য কবিতা / সমুদ্র গুপ্ত

...

তোমার আকাশ থেকে আমার জন্য
কেবলই লাবণ্য ঝরে না
মেঘ জমে শিশিরের ঘাম হয়ে
শিলা ও পাথর জমে মেঘে
বিষ্টির নাম করে

হাওয়ার চাদর উড়িয়ে তোমার অস্তিত্ব নামে
নেমে আসে
আমার পাতা ও কাণ্ডের ওপর
পাখির পালক হয়ে স্নিগ্ধতা গড়িয়ে পড়ে
কোনো কিছু স্নেহ নয় প্রিয়তা নয়
পাথর গড়িয়ে পড়ে গলে যায়

তোমার আকাশ থেকে আমার ওপরে
কোনোই লাবণ্য ঝরে না
তবু
টিকে থাকি বেঁচে থাকি
বিষ্টির লবণ একদিন লাবণ্য জমাবে

আমাদের জীবন শিকড়ে
...

মাছি / সমুদ্র গুপ্ত

...

এইভাবে বিবাদ ও বিষাদে অন্তহীন ডুবে যাওয়া
কতদিন আর কতকাল
দ্বিধাহীন দ্বিত্বহীন একক সঞ্চারে
চেয়ারের হাতলের সাথে স্ট্যাটাসের শিকলে বাঁধা হাত
যেন চারপাশে আর কিছু নেই কেউ নেই

আমরা কি ভুলে যাবো ডুমরিয়া আত্রাই পেয়ারা বাগান
হাকালুকি শীতলক্ষার রক্তরাঙা জল
নড়াইল আর চিত্রার অবস্থান একটুয়ো না পাল্টানোর স্মৃতি কি
স্মৃতি থেকে বিস্মৃতির অতলে তলাবে

সম্মুখ ও পশ্চাত আজ একাকার / সমু্দ্র গুপ্ত

...

কে যায় আর কে কে আসে
বোঝা যায় না
বিশাল চওড়া পথে
কতো মানুষ কতো যানবাহন
এইসবের
কারা যায় আর কারা আসে
কে জানে

যাকে দেখা যাচ্ছে, চলে যাচ্ছে
অথচ সে যাচ্ছে না
তার গন্তব্য থেকে বোঝা যায় সে যাচ্ছে না
আসছে সে

কুকুর / সমুদ্র গুপ্ত

...

রাস্তার মধ্যিখানে শুয়ে আছে নির্বিকার একটি কুকুর
গাড়ি ঘোড়া ছুটে যাচ্ছে এদিক ওদিক
পাশ কেটে কুকুরের মাথার, ছায়ার
প্রাণহীন কুকুরের হৃদপিণ্ড কুঁকড়ে গেছে
খামচে ধরে রাজপথ কোঠাবাড়ি নাগরিক বিশাল শহর

সভা শেষ হলে / সমুদ্র গুপ্ত

...

‘তুমুল করতালির মধ্য দিয়ে সভা শেষ হলে
বক্তৃতার মধ্যেকার মিথ্যাগুলো
বাদুড়ের মতো উড়ে যায় বিভ্রান্তির অন্ধকারের দিকে
সেখানে রয়েছে স্বার্থের ডাঁসা পেয়ারা
খাবে কামড়াবে ছড়াবে ছিটকাবে আর
বাকিটা নষ্ট করবে এমনভাবে যেন
অন্য কারও আহারে রুচি না হয়

বন্ধুদের প্রতি / সমুদ্র গুপ্ত

...

তোমরা কীভাবে যে কি কি বলো বুঝতে পারি না
নদীর চলে যাবার কথা বোঝা যায়
নদীর থেমে থাকার কথা বোঝা যায়
ঘাস খেতে খেতে
বাছুরের মাথা তুলে আকাশ দেখার কথা বোঝা যায়
মেঘ ও বৃষ্টির ভাষা বোঝা যায়
পথ ও বিপথের কথা বোঝা যায়
সন্ধ্যা কিংবা সকাল
বৃষ্টি ও রোদের ভিতরে গাছের ভাষা বোঝা যায়

চাল কিভাবে গুমরাতে গুমরাতে ভাত হয়
তা-ও বোঝা যায়
কিন্তু
তোমরা কি কি যে কীভাবে বলো বোঝা যায় না
...

মানুষের নিয়ম / সমুদ্র গুপ্ত

...

স্বাধীনতা জিনিসটা অন্যরকম
একেক পরিপ্রেক্ষিতে একেক বিষয়কেন্দ্রে
একেক পরিস্থিতিতে একেক চাহিদাক্ষেত্রে
স্বাধীনতার একেক চেহারা

আজ যা তোমার স্বাধীনতা
একই সাথে অন্যের ক্ষেত্রে বিপরীত
আবার
সহসাই এটির চিত্র ও ভঙ্গি পাল্টে যায়

পাথর ও বরফ / সমুদ্র গুপ্ত

...

ভালোবাসা হচ্ছে এক প্রকার পাথর
দুজনে এক সাথে ছুঁয়ে দিলে
নড়ে চড়ে কথা বলে, আলো বিকীরণ করে
ছুঁয়ে না দিলে
আলো না জ্বললে
ভালোবাসা কেবলই পাথর

দেশপ্রেম কেবলই বরফ
মিছিলের উত্তাপে গলে
...

এই বাংলার মাটি / সমুদ্র গুপ্ত

...

আদর্শ বর্গ আয়তনে
সর্বাপেক্ষা ক্ষুদ্র পরিমাপের
একখন্ড মাটি নিয়ে হাতে তুলতেই সন্দেহ হলো
লাল নাকি ! মাটির মতো লোহাও লবন !

নানান চেহারা ছবি নানান ভঙ্গি
একটুকরো মাটির বর্গে
একেক আলোর নিয়মে একেক ঘটনা ফোটায়

বিভ্রম / সমুদ্র গুপ্ত

...

ছেলেবেলায় একবার এক
সম্পন্ন আত্মীয় বাড়ি বেড়াতে গিয়ে
কারুকার্যময় আলমারির ভিতরে রাখা
সুন্দর পুতুল দেখে হাত বাড়িয়ে ধরতে গিয়ে
আলমারির কাঁচ ভেঙে ফেলেছিলাম
পুতুলের কাছ থেকে ফিরে এসেছিলো
রক্তাক্ত ক্ষুব্ধ আঙুল

যৌবনে-
চমৎকার তিল দেখে
হাত দিয়ে ছুঁতে যেতেই
তোমার লাল গাল থেকে
উড়ে গেলো মাছি

শুধু নদী ও মানুষেরা / সমুদ্র গুপ্ত

...

অদ্ভুত চরিত্র নদীর
এই কিছুকাল আগে যেখানে যেভাবে ছিল
আজ আর সেখানে নেই
আগামীকাল এখানে থাকবে না

অদ্ভুত চরিত্র মানুষের
এই কিছুকাল আগে যেখানে যেভাবে ছিল
আজ আর সেখানে নেই
আগামীকাল এখানে থাকবে না

Saturday, November 28, 2009

একসময় ইচ্ছে জাগে, এভাবেই / আবুল হাসান

...

একসময় ইচ্ছে জাগে, মেষপালকের বেশে ঘুরিফিরি;
অরণ্যের অন্ধকার আদিম সর্দার সেজে মহুয়ার মাটির বোতল
ভেঙ্গে উপজাতি রমণীর বল্কল বসন খুলে জ্যোৎস্নায় হাঁটু গেড়ে বসি-

আর তারস্বরে বলে উঠি নারী, আমি মহুয়া বনের এই
সুন্দর সন্ধ্যায় পাপী, তোমার নিকটে নত, আজ কোথাও লুকানো কোনো
কোমলতা নেই, তাই তোমার চোখের নীচে তোমার ভ্রুর নীচে
                                           তোমার তৃষ্ণার নীচে
এই ভাবে লুকিয়েছি পিপাসায় আকণ্ঠ উন্মাদ আমি
ক্ষোভে ও ঈর্ষায় সেই নগরীর গুপ্তঘাতক আজ পলাতক, খুনী
আমি প্রেমিককে পরাজিত করে হীন দস্যুর মতোন
খুনীকে খুনীর পাশে রেখে এখানে এসেছি, তুমি
আমাকে বলো না আর ফিরে যেতে, যেখানে কেবলি পাপ, পরাজয়
পণ্যের চাহিদা, লোভ, তিরীক্ষু-মানুষ- যারা কোজাগরী ছুরি
বৃষ্টির হল্লায় ধুয়ে প্রতি শনিবারে যায় মদ্যশালায়, যারা
তমসায় একফোঁটা আলোও এখন আর উত্তোলন করতে জানে না।
আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে ঝরে পড়ে কেবলি যাদের রক্ত, রাত্রিবেলা আমি আজ
তোমার তৃষ্ণার নীচে নিভৃতের জ্যোৎস্নায় হাঁটু গেড়ে বসেছি আদিম আজ
এখন আমার কোন পাপ নেই, পরাজয় নেই।
একসময় ইচ্ছে জাগে, এভাবেই অরণ্যে অরণ্যে ঘুরে যদি দিন যেতো।
...

অপরূপ বাগান / আবুল হাসান

...

চলে গেলে- তবু কিছু থাকবে আমার : আমি রেখে যাবো
আমার একলা ছায়া, হারানো চিবুক, চোখ, আমার নিয়তি।
জল নেমে গেলে ডাঙ্গা ধরে রাখে খড়কুটো, শালুকের ফুল :
নদীর প্রবাহপলি, হয়তো জন্মের বীজ, অলঙ্কার- অনড় শামুক !

তুমি নেমে গেলে এই বক্ষতলে সমস্ত কি সত্যিই ফুরোবে ?
মুখের ভিতরে এই মলিন দাঁতের পংক্তি- তা হলে এ চোখ
মাথার খুলির নীচে নরোম নির্জন এক অবিনাশী ফুল :
আমার আঙ্গুলগুলি, আমার আকাঙ্ক্ষাগুলি, অভিলাষগুলি ?

Friday, November 27, 2009

স্রোতে রাজহাঁস আসছে / আবুল হাসান

...

পুনর্বার স্রোতে ভাসছে হাঁস, ভাসতে দাও
                  কোমল জলের ঘ্রাণ মাখুক হাঁসেরা;
বহুদিন পর ওরা জলে নামছে, বহুদিন পর ওরা কাটছে সাঁতার
                  স্রোতে রাজহাঁস আসছে, আসতে দাও,

বহুদিন পর যেনো রোদ আসছে, আসতে দাও
                 নত হতে দাও আকাশকে,
                 আর একটু নত হোক আলো
                 আর একটু নির্জন হোক অন্ধকার !

আর তুমি পরে নাও তোমার গহনা, দুল
তোমার আঙ্গুল হোক হেমন্তের ফুল,
                  আমি শুঁকি, শুঁকতে দাও !

প্রতিক্ষার শোকগাথা / আবুল হাসান

...

তোমার চোখের মতো কয়েকটি চামচ পড়ে আছে দ্যাখো প্রশান্ত টেবিলে
আর আমার হাত ঘড়ি
নীল ডায়ালের তারা জ্বলছে মৃদু আমারই কব্জিতে !

টুরিস্টের মতো লাগছে দেখতে আমাকে
সাংবাদিকের মতো ভীষণ উৎসাহী

এ মুহূর্তে সিগ্রেটের ছাই থেকে
শিশিরের মতো নম্র অপেক্ষার কষ্টগুলি ঝেড়ে ফেলেছি কালো এ্যাসট্রেতে !

রেস্তোরাঁয় তুমি কি আসবেনা আজ স্বাতী ?

অসভ্য দর্শন / আবুল হাসান

...
(নির্মলেন্দু গুণকে)

দালান উঠছে তাও রাজনীতি, দালান ভাঙছে তাও রাজনীতি,

দেবদারু কেটে নিচ্ছে নরোম কুঠার তাও রাজনীতি,

গোলাপ ফুটছে তাও রাজনীতি, গোলাপ ঝরছে তাও রাজনীতি !

মানুষ জন্মাচ্ছে তাও রাজনীতি, মানুষ মরছে তাও রাজনীতি !

বোন তার বেণী খুলছে, যৌবনের অসহায় রোদে মুখ নত কোরে
বুকের ভ্রমর হাতে রাখছে লুকিয়ে- তাও রাজনীতি

সেই সুখ / আবুল হাসান

...
(সুফিয়া চৌধুরীকে)

সেই সুখ মাছের ভিতরে ছিল,
সেই সুখ মাংসের ভিতরে ছিল,
রাতের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যেতো ছেলেবেলা
সেই সুখ চাঁদের ভিতরে ছিল,
সেই সুখ নারীর ভিতরে ছিল !

নারী কোন রমণীকে বলে ?
যার চোখ মুখ স্তন ফুটেছে সেই রমণী কি নারী ?
সেই সুখ নারীর ভিতরে ছিল,
যখন আমরা খুব গলাগলি শুয়ে
অনু অপলাদের স্তন শরীর মুখ উরু থেকে
অকস্মাৎ ঝিনুকের মতো যোনি,
অর্থাৎ নারীকে আমরা যখোন খুঁজেছি
হরিণের মতো হুররে দাঁত দিয়ে ছিঁড়েছি তাদের নখ, অন্ধকারে
সেই সুখ নারীর ভিতরে ছিল।

স্মৃতিকথা / আবুল হাসান

...

(হেলাল, কাঞ্চন, ওয়ালী, বাচ্চু ও রাব্বীকে)

যে বন্ধুরা কৈশোরে নারকেল বনের পাশে বসে
আত্মহত্যার মতো বিষণ্ন উপায়ে উষ্ণ মেয়েদের গল্প কোরতো
শীতকালে চাঁদের মতোন গোল বোতামের কোট পড়ে
                       ঘুরতো পাড়ায়,
যে বন্ধুরা থিয়েটারে পার্ট কোরতো,
কেউ সাজতো মীরজাফর, কেউবা সিরাজ
                        তারা আজ, এখন কোথায় ?

রোমেনা যে পড়াতো ইশকুলে ছোট মনিদের বিদ্যালয়ে
রোমেনা যে বুদ্ধদেব বসুর উপন্যাস পড়ে তার
                         নায়িকার মতো জ্বরে ভুগতো,
আর মিহি শরীরের সাথে মিল রেখে
                         কপালে পরতো টিপ,
শাদা কোমরের কাছে দীর্ঘচুল ঝুলিয়ে রাখতো
                          ব্লু কালারের ব্যাগ,

বৃষ্টি চিহ্নিত ভালোবাসা / আবুল হাসান

...

মনে আছে একবার বৃষ্টি নেমেছিল ?

একবার ডাউন ট্রেনের মতো বৃষ্টি এসে থেমেছিল
আমাদের ইস্টিশনে সারাদিন জল ডাকাতের মতো
উৎপাত শুরু করে দিয়েছিল তারা;
ছোট-খাটো রাজনীতিকের মতো পাড়ায়-পাড়ায়
জুড়ে দিয়েছিল অথই শ্লোগান।

তবু কেউ আমাদের কাদা ভেঙে যাইনি মিটিং-এ
থিয়েটার পণ্ড হলো, এ বৃষ্টিতে সভা আর
তাসের আড্ডার লোক ফিরে এলো ঘরে;
ব্যবসার হলো ক্ষতি দারুণ দুর্দশা,

মাতৃভাষা / আবুল হাসান

...

আমি জানিনা দুঃখের কী মাতৃভাষা
ভালোবাসার কী মাতৃভাষা
বেদনার কী মাতৃভাষা
যুদ্ধের কী মাতৃভাষা।

আমি জানিনা নদীর কী মাতৃভাষা
নগ্নতার কী মাতৃভাষা
একটা নিবিড় বৃক্ষ কোন ভাষায় কথা বলে এখনো জানিনা।

শুধু আমি কোথাও ঘরের দরোজায় দাঁড়ালেই আজো
সভ্যতার শেষ মানুষের পদশব্দ শুনি আর
কোথাও করুণ জল গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে,
আর সেই জলপতনের শব্দে সিক্ত হতে থাকে
সর্বাঙ্গে সবুজ হতে থাকে আমার শরীর।

জন্ম মৃত্যু জীবনযাপন / আবুল হাসান

...

মৃত্যু আমাকে নেবে, জাতিসংঘ আমাকে নেবেনা,

আমি তাই নিরপেক্ষ মানুষের কাছে, কবিদের সুধী সমাবেশে
আমার মৃত্যুর আগে বোলে যেতে চাই,
সুধীবৃন্দ ক্ষান্ত হোন, গোলাপ ফুলের মতো শান্ত হোন
কী লাভ যুদ্ধ কোরে ? শত্রুতায় কী লাভ বলুন ?
আধিপত্যে এত লোভ ? পত্রিকা তো কেবলি আপনাদের
ক্ষয়ক্ষতি, ধ্বংস আর বিনাশের সংবাদে ভরপুর...

পাখি হয়ে যায় প্রাণ / আবুল হাসান

...

অবশেষে জেনেছি মানুষ একা !

জেনেছি মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা !
দৃশ্যের বিপরীত সে পারে না একাত্ম হতে এই পৃথিবীর সাথে কোনোদিন।
ফাতিমা ফুফুর প্রভাতকালীন কোরানের
মর্মায়িত গানের স্মরণে তাই কেন যেনো আমি

চলে যাই আজো সেই বর্নির বাওড়ের বৈকালিক ভ্রমণের পথে,
যেখানে নদীর ভরা কান্না শোনা যেত মাঝে মাঝে
জনপদবালাদের স্ফুরিত সিনানের অন্তর্লীন শব্দে মেদুর !

বনভূমির ছায়া / আবুল হাসান

...

কথা ছিল তিনদিন বাদেই আমরা পিকনিকে যাবো,
বনভূমির ভিতরে আরো গভীর নির্জন বনে আগুন ধরাবো,
আমাদের সব শীত ঢেকে দেবে সূর্যাস্তের বড় শাল গজারী পাতায়।

আমাদের দলের ভিতরে যে দুইজন কবি
তারা ফিরে এসে অরণ্য স্তুতি লিখবে পত্রিকায়
কথা ছিল গল্পলেখক অরণ্য যুবতী নিয়ে গল্প লিখবে নতুন আঙ্গিকে !

আবুল হাসান / আবুল হাসান

...

সে এক পাথর আছে কেবলি লাবণ্য ধরে, উজ্জ্বলতা ধরে আর্দ্র,
                                     মায়াবী করুণ
এটা সেই পাথরের নাম নাকি ? এটা তাই ?
এটা কি পাথর নাকি কোনো নদী ? উপগ্রহ ? কোনো রাজা ?
পৃথিবীর তিনভাগ জলের সমান কারো কান্না ভেজা চোখ ?
মহাকাশে ছড়ানো ছয়টি তারা ? তীব্র তীক্ষ্ণ তমোহর
কী অর্থ বহন করে এই সব মিলিত অক্ষর ?

স্বগতোক্তি / শোয়েব শাদাব

...

নষ্ট দ্রাঘিমায় এসে গেছি হে দেবদূত !

অস্থিতে মজ্জায় হিম জমে গেছে অজস্র কর্দম
কী করতে কী করে ফেলি বুঝি না পূর্বাপর
কেঁচো খুঁড়ে অজগর !

বুকের ভিতর যেন অহরহ টমটমের শব্দ
                         শুনতে পাই।
প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকূপে পড়ে থাকি
বিকল জন্তুর মতো পঙ্গুতায়- আর
স্তব্ধ পরাধীনতায়।
ছায়াকে কায়াকে যুগপৎ করে তুলি শত্রু
পারি না এড়াতে অলৌকিক রাক্ষস-সন্দেহ
রক্তের গভীরে যেন ঘাই মারে বিষধর শিং !
উরুর আগুনে চেপে যৌবন বল্লম
কেঁপে উঠি মধ্যরাতে-
স্বপ্নের ডানার মতো নেমে আসে সংখ্যাহীন সিল্কের বালিশ
হাতের কলম দড়ি ছিঁড়ে
সাপ হয়ে যায়
সাপ, ময়ূর।

অতঃপর,
ফুলের কঙ্কাল থেকে নিঃসৃত সৌরভ
তরল মৃত্যুকে পান করে
বিষাদে বিনাশে হই পূর্ণাঙ্গ পুরুষ।
...

চাষাবাদ / আবু হাসান শাহরিয়ার

...

নেড়ে দেখলাম, ছেনে দেখলাম,
অসুখ অনাবাদের-
শুশ্রূষা তার আদর।
সংকোচের শীত তাড়াতে
আলিঙ্গনের চাদর
পরিয়ে দিলাম গায়ে।

তোমার পায়ে-পায়ে
শঙ্কা এবং দ্বিধায় ঘোরাফেরা।
একজীবনে এতটা চুলচেরা
হিসেব করা ভালো ?

চুম্বনের জলে তোমায় সিক্ত করি, এসো,
দশ আঙুলে লাঙল দেব বুকে,
আসঙ্গম শরীরময় শৃঙ্গারের বীজ
ছড়িয়ে দেব ঝুঁকে।

কী লাভ বলো ব্রাত্য পড়ে থেকে ?
বাসের যোগ্য যে-জন, তাকে ভিটেয় রাখো তুলে।
এই ভূমিহীন চাষাকে দাও বর্গা চাষের মাটি-
ক্লান্তিহীন প্রেমে ফলাই সুখের খুঁটিনাটি।
...

শব্দাকাশে চাঁদ উঠেছে / আবু হাসান শাহরিয়ার

...

'আকাশ' লিখতে চন্দ্রবিন্দু বসিয়ে দিলে 'আ'-এর মাথায়-
লিখলে 'আঁকাশ'।
বললে হেসে, 'আজ আঁকাশে চাঁদ উঠেছে।'

এই যে তুমি শব্দাকাশে চাঁদ ওঠালে,
এ চাঁদ কেবল বাঙলা ভাষায় উঠতে পারে।
অন্য ভাষায় এই ঘটনা অনিবর্চন।
তুমিই বলো, তর্জমা হয় এই কবিতার ?
বাঙলা ছাড়া কোন ভাষাতে চন্দ্রবিন্দু হয় বা আছে ?

'আকাশ' লিখতে এখন থেকে বিন্দুসমেত চন্দ্র দেব।
শব্দাকাশে উঠুক না চাঁদ।
এখন থেকে 'আকাশ' ভুলে 'আঁকাশ' লিখব তোমার জন্য।
...

তুলাদণ্ড / আবু হাসান শাহরিয়ার

...

তোমার চোখের চেয়ে বেশি নীল অন্য কোনও আকাশ ছিল না
যেখানে উড়াল দিতে পারি
তোমার স্পর্শের চেয়ে সুগভীর অন্য কোনও সমুদ্র ছিল না
যেখানে তলিয়ে যেতে পারি
তোমাকে দ্যাখার চেয়ে নির্নিমেষ অন্য কোনও দ্রষ্টব্য ছিল না
যেখানে নিমগ্ন হতে পারি
তোমাকে খোঁজার চেয়ে বেশি দূর অন্য কোনও গন্তব্য ছিল না
যেখানে হারিয়ে যেতে পারি।

কেবল তোমার চেয়ে বেশি দীর্ঘ তুমিহীন একাকী জীবন।
...

আদ্যোপান্ত / আবু হাসান শাহরিয়ার

...

তুমি আমার বহুলপাঠে মুখস্থ এক কাব্যগ্রন্থ-
তোমার প্রতি পঙক্তি আমি পাঠ করেছি মগ্ন হয়ে।
বই কখনো ধার দিতে নেই, জেনেও আমি দিয়েছিলাম-
খুইয়েছি তাই।
ছিঁচকে পাঠক হলেও তোমার গ্রন্থস্বত্ব এখন তারই।

বইচোরা কি কাব্যরসিক ? ছন্দ জানে ?
বই অনেকের বাতিক, ঘরে সাজিয়ে রাখে-
নাকি তেমন হদ্দ নবিশ ?
চোরের ঘরে ধুলোয় মলিন বুকশেলফে কেমন আছো ?

চোর কি জানে, চোর কি জানত,
আমি তোমায় মুখস্থ পাই আদ্যোপান্ত ?
...

Tuesday, November 24, 2009

পুরাতন ভৃত্য / রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

...

ভূতের মতন চেহারা যেমন,   নির্বোধ অতি ঘোর—
যা‐কিছু হারায়, গিন্নি বলেন,   “কেষ্টা বেটাই চোর।”
উঠিতে বসিতে করি বাপান্ত,   শুনেও শোনে না কানে,
যত পায় বেত না পায় বেতন,   তবু না চেতন মানে।
বড়ো প্রয়োজন, ডাকি প্রাণপণ   চীৎকার করি “কেষ্টা”—
যত করি তাড়া নাহি পাই সাড়া,   খুঁজে ফিরি সারা দেশটা।
তিনখানা দিলে একখানা রাখে,   বাকি কোথা নাহি জানে;
একখানা দিলে নিমেষ ফেলিতে   তিনখানা করে আনে।
যেখানে সেখানে দিবসে দুপুরে   নিদ্রাটি আছে সাধা;
মহাকলরবে গালি দেই যবে   “পাজি হতভাগা গাধা”—
দরজার পাশে দাঁড়িয়ে সে হাসে,   দেখে জ্বলে যায় পিত্ত,
তবু মায়া তার ত্যাগ করা ভার— বড়ো পুরাতন ভৃত্য।

স্বপ্ন / রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

...

          দূরে বহুদূরে
     স্বপ্নলোকে উজ্জয়িনীপুরে
খুঁজিতে গেছিনু কবে শিপ্রানদীপারে
মোর পূর্বজনমের প্রথমা প্রিয়ারে।
মুখে তার লোধ্ররেণু, লীলাপদ্ম হাতে,
কর্ণমূলে কুন্দকলি, কুরুবক মাথে,
তনু দেহে রক্তাম্বর নীবিবন্ধে বাঁধা,
চরণে নূপুরখানি বাজে আধা আধা।
          বসন্তের দিনে
ফিরেছিনু বহুদূরে পথ চিনে চিনে।

জুতা-আবিষ্কার / রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

...

কহিলা হবু, ‘শুন গো গোবুরায়,
         কালিকে আমি ভেবেছি সারা রাত্র—
মলিন ধূলা লাগিবে কেন পায়
         ধরণী‐মাঝে চরণ‐ফেলা মাত্র!
তোমরা শুধু বেতন লহ বাঁটি,
         রাজার কাজে কিছুই নাহি দৃষ্টি।
আমার মাটি লাগায় মোরে মাটি,
         রাজ্যে মোর একি এ অনাসৃষ্টি!
               শীঘ্র এর করিবে প্রতিকার,
               নহিলে কারো রক্ষা নাহি আর।’

কণিকা / রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

...

যথার্থ আপন

কুষ্মাণ্ডের মনে মনে বড়ো অভিমান,
বাঁশের মাচাটি তার পুষ্পক বিমান।
ভুলেও মাটির পানে তাকায় না তাই,
চন্দ্রসূর্যতারকারে করে `ভাই ভাই’।
নভশ্চর ব’লে তাঁর মনের বিশ্বাস,
শূন্য-পানে চেয়ে তাই ছাড়ে সে নিশ্বাস।
ভাবে, `শুধু মোটা এই বোঁটাখানা মোরে
বেঁধেছে ধরার সাথে কুটুম্বিতাডোরে;
বোঁটা যদি কাটা পড়ে তখনি পলকে
উড়ে যাব আপনার জ্যোতির্ময় লোকে।’
বোঁটা যবে কাটা গেল, বুঝিল সে খাঁটি—
সূর্য তার কেহ নয়, সবই তার মাটি।

Monday, November 23, 2009

বৃষ্টিসম্ভাবনা / রহমান হেনরী

...

জমাট বেঁধেছে মেঘ ...
না ... ওভাবে নেড়ো না ! বর্ষণ আসন্ন হতে পারে
ভিজে যেতে পারে সুখ,
ভিজে ভিজে ভেসে যেতে পারে, ও তোমার
আর্তভাষী ক্ষেত; এ প্রকার বৃষ্টিসম্ভাবনা
মুহূর্তে জাগিয়ে তুলে বিলম্বিত হতে দেয়া ভালো,
তাতে উত্তেজনা হয়, পরিণত হয় পরিণতি।

অনুসিদ্ধান্ত / রহমান হেনরী

...

কষ্ট সহজ,
বুকের ভেতর কষ্ট পোষা, সহজ না ...
স্পর্শ সহজ,
হৃদয় দিয়ে হৃদয় ছোঁয়া, সহজ না ...

ইচ্ছে হলেই কাঁদাও তুমি, কান্না সহজ;
পাখির মতো ওড়াও দেখি ! হাসাও দেখি !
সুখের স্রোতে মাতাল হৃদয় ভাসাও দেখি !
সহজ না

ফ্যাশন শো / বিশ্বজিৎ চৌধুরী

...

বাহ, তোমাদের ফিগার তো ভালো !
হেঁটে আসছো, ভেসে আসছো, দুলে উঠছো
বিপজ্জনক সব বাঁক থেকে ঠিকরে পড়ছে আলো।

বেশ তো ভ্রূ-তীর জানো মেয়ে, বিদ্যুতে দুফালি হয় মেঘ
এই তথ্য কখন জেনেছো ? ভালো,
জেনেছো বলেই না আজ রাতে বজ্রপাতের আগে
নিঃশব্দে আগুন চমকালো।
সুরের মূর্ছনা থেকে আছড়ে পড়ছে ঢেউ
ঢেউ মানে সমুদ্র-আবহ
খুবই অর্থবহ এই জল, স্রোত ভেঙে ছুটে আসছে কেউ
                                     জেগে ওঠা নগ্ন জলপরী ?
দেখো দেখো, ধসে পড়ছে সমুদ্র-সংলগ্ন বালিয়াড়ি।

কৃষ্ণপক্ষে / বিশ্বজিৎ চৌধুরী

...

কৃষ্ণপক্ষের খুব গাঢ় কোন রাতে, আফ্রিকার
কোন এক কৃষ্ণাঙ্গ রমণী, মনে কর অজ্ঞাত কারণে
সম্পূর্ণ বিবস্ত্র হয়ে হেঁটে গেল ঘরে উঠোনে
তারপর ত্রস্ত পায়ে উঠোন পেরিয়ে, দূরপথে
ছুটে যাচ্ছে ছেনালির ঢঙে।

লিলি গাঙ্গুলি পাখি নয় / ওমর কায়সার

...

লিলি গাঙ্গুলি পাখি নয়
তাই তার গান শুনতে পেয়েছিলাম খুব কাছাকাছি থেকে।

পাখিরা শোনায় গান দূর থেকে
আর অবণ্যে সে আমাকে শুনিয়েছিল গান পাশাপাশি হেঁটে
পাতার জড়তা ভাঙতে ভাঙতে পাখির স্বভাবে।

তার নখ নিখুঁত রক্তিম
তাজা কোনো শালিকের রক্ত দিয়ে মাখা
পোষা কোনো টিয়ের মত তার পায়ে বাঁধা ছিল রূপোর নুপূর।

উত্তরসাধক / আবু হাসান শাহরিয়ার

...

যে আমাকে অস্বীকার করে
প্রথমত অকবি সে; দ্বিতীয়ত পরশ্রীকাতর

হয়তো সে মিডিয়াপালিত কোনও প্রাবন্ধিক; ভুলবাক্যে বুকরিভিউ করে
অথবা সে আসল কালপ্রিট, দ্যাখে বড়কাগজের লঘু সাহিত্য পাতাটি
নতুবা সে ছোট কোনও কাগজের পাতি সম্পাদক
নিজেকে জাহির করে নিজের কাগজে
কাগজে-কাগজে করে সখ্যবিনিময়

তোমাদের কাচের শহরে / আবু হাসান শাহরিয়ার

...

মাঠ একা শুয়ে আছে মাঠে
ঘাট বলে, নৌকা ভেড়াও
মেঘের কাঁচুলি খুলে দূরের দিগন্ত ডাকে কাছে
স্তন বলে, মুঠোবন্দি করো
মন বলে, হও বীর্যবান

জীবিকাচাতুর্য আছে; প্রেম নেই তোমাদের কাচের শহরে

কারণ আমরা ফিরছি / কামাল চৌধুরী

...

লামাদের মতো মুণ্ডিত মাথা নিয়ে বাড়ি ফিরছে অচেনা রাত
সন্ধ্যার দ্রুততায় ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে জেতবন। শ্রমণের ভিক্ষার ঝুলিতে যে পরিমাণ আড়াল
ছিল অথবা নির্বাণের জন্য তোমার অসামান্য দান- হে অগ্রশ্রাবিকা, দ্যাখো সেখানেও
শীতের চিৎকার
তবে কি তোমারও পাত্রে আহার্য অবশিষ্ট নেই ? কেবল চিৎকার, আমাদের গন্তব্যের মুখে
এইভাবে ফাঁকা হয়ে যাবে পান্থশালা ?

মানুষ / খোন্দকার আশরাফ হোসেন

...

মানুষকে কেউ ধারণ করতে পারে না
না নিসর্গ ঈশ্বর না প্রেম না ঘৃণা
মানুষের হাতে নীল বেলুন তার চোখে দুই কালো মাছি
মানুষকে কেউ ধারণ করতে পারে না, মানুষের
কোনো জন্মদাতা নেই, তার কটির উত্তাল যৌবন কারো
উত্তরাধিকার নয়।

দৃশ্যের বাহিরে / নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

...

সিতাংশু, আমাকে তুই যতো কিছু বলতে চাস, বল।
যতো কথা বলতে চাস, বল।
অথবা একটাও কথা বলিসনে, তুই
বলতে দে আমাকে তোর কথা।
সিতাংশু, আমি যে তোর সমস্ত কথাই জেনে গেছি।
আমি জেনে গেছি।

Sunday, November 22, 2009

দারিদ্র্যরেখা / তারাপদ রায়

...

আমি নিতান্ত গরিব ছিলাম, খুবই গরিব।
আমার ক্ষুধার অন্ন ছিল না,
আমার লজ্জা নিবারণের কাপড় ছিল না,
আমার মাথার উপরে আচ্ছাদন ছিল না।
অসীম দয়ার শরীর আপনার
আপনি এসে আমাকে বললেন,
'না, গরিব কথাটা খুব খারাপ,
ওতে মানুষের মর্যাদাহানি হয়,
তুমি আসলে দরিদ্র।'

আমি যদি হতাম / জীবনানন্দ দাশ

...

আমি যদি হতাম বনহংস;
বনহংসী হতে যদি তুমি;
কোনো এক দিগন্তের জলসিঁড়ি নদীর ধারে
ধানক্ষেতের কাছে
ছিপছিপে শরের ভিতর
এক নিরালা নীড়ে,
তাহলে আজ এই ফাল্গুনের রাতে
ঝাউয়ের শাখার পেছনে চাঁদ উঠতে দেখে
আমরা নিম্নভূমির জলের গন্ধ ছেড়ে
আকাশের রূপালি শস্যের ভিতর গা ভাসিয়ে দিতাম-
তোমার পাখনায় আমার পালক, আমার পাখনায় তোমার রক্তের স্পন্দন-
নীল আকাশে খইক্ষেতের সোনালি ফুলের মতো অজস্র তারা,
শিরীষ বনের সবুজ রোমশ নীড়ে
সোনার ডিমের মতো
ফাল্গুনের চাঁদ।

হয়তো গুলির শব্দ:
আমাদের তির্যক গতিস্রোত,
আমাদের পাখায় পিসটনের উল্লাস,
আমার কণ্ঠে উত্তর হাওয়ার গান।
হয়তো গুলির শব্দ আবার:
আমাদের স্তব্ধতা, আমাদের শান্তি।
আজকের জীবনের এই টুকরো টুকরো মৃত্যু আর থাকত না;
থাকত না আজকের জীবনের টুকরো টুকরো সাধের ব্যর্থতা ও অন্ধকার;
আমি যদি বনহংস হতাম,
বনহংসী হতে যদি তুমি;
কোনো এক দিগন্তের জলসিঁড়ি নদীর ধারে
ধানক্ষেতের কাছে।
...

বনভূমিকে বলো / আবুল হাসান

...

বনভূমিকে বলো, বনভূমি, অইখানে একটি মানুষ
লম্বালম্বি শুয়ে আছে, অসুস্থ মানুষ
হেমন্তে হলুদ পাতা যেরকম ঝরে যায়,
ও এখন সে রকম ঝরে যাবে, ওর চুল, ওর চোখ
ওর নখ, অমল আঙুল সব ঝরে যাবে,
বনভূমিকে বলো, বনভূমি অইখানে একটি মানুষ
লম্বালম্বি শুয়ে আছে, অসুস্থ মানুষ
ও এখন নদীর জলের স্রোতে ভেসে যেতে চায়
ও এখন মাটি হতে চায়, শুধু মাটি
চকের গুঁড়োর মতো ঘরে ফিরে যেতে চায়,
বনভূমিকে বলো, বনভূমি ওকে আর শুইয়ে রেখো না !

ওকে ঘরে ফিরে যেতে দাও। যে যাবার
সে চলে যাক, তাকে আর বসিয়ে রেখো না।
...

বারবারা বিডলারকে / আসাদ চৌধুরী

...

বারবারা
ভিয়েতনামের উপর তোমার অনুভূতির তরজমা আমি পড়েছি-
তোমার হৃদয়ের সুবাতাস
আমার গিলে-করা পাঞ্জাবিকে মিছিলে নামিয়েছিল
প্রাচ্যের নির্যাতিত মানুষগুলোর জন্যে অসীম দরদ ছিল সে লেখায়
আমি তোমার ওই একটি লেখাই পড়েছি
আশীর্বাদ করেছিলাম, তোমার সোনার দোয়াত কলম হোক।
আমার বড়ো জানতে ইচ্ছে করে বারবারা, তুমি এখন কেমন আছ ?
নিশ্চয়ই তুমি ডেট করতে শিখে গেছ।
গাউনের রঙ আর হ্যাট নিয়ে কি চায়ের টেবিলে মার সঙ্গে ঝগড়া হয় ?
অনভ্যস্ত ব্রেসিয়ারের নিচে তোমার হৃদয়কে কি চিরদিন ঢেকে দিলে।
আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করে বারবারা।
তোমাদের কাগজে নিশ্চয়ই ইয়াহিয়া খাঁর ছবি ছাপা হয়-
বিবেকের বোতামগুলো খুলে হৃদয় দিয়ে দেখো
ওটা একটা জল্লাদের ছবি
পনেরো লক্ষ নিরস্ত্র লোককে ঠাণ্ডা মাথায় সে হ্ত্যা করেছে
মানুষের কষ্টার্জিত সভ্যতাকে সে গলা টিপে হত্যা করেছে
অদ্ভুত জাদুকরকে দেখ
বিংশ শতাব্দীকে সে কৌশলে টেনে হিঁচড়ে মধ্যযুগে নিয়ে যায়।
দেশলাইয়ের বাক্সর মতো সহজে ভাঙে
গ্রন্থাগার, উপাসনালয়, ছাত্রাবাস,
মানুষের সাধ্যমত ঘরবাড়ি
সাত কোটি মানুষের আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের ফুলকে সে বুট জুতোয়
থেতলে দেয়।


টু উইমেন ছবিটা দেখেছ বারবারা ?
গির্জার ধর্ষিতা সোফিয়া লোরেনকে দেখে নিশ্চয়ই কেঁদেছিলে
আমি কাঁদিনি, বুকটা শুধু খাঁ খাঁ করেছিল-
সোফিয়া লোরেনকে পাঠিয়ে দিয়ো বাংলাদেশে
তিরিশ হাজার রমণীর নির্মম অভিজ্ঞতা শুনে
তিনি শিউরে উঠবেন।
অভিধান থেকে নয়
আশি লক্ষ শরণার্থীর কাছে জেনে নাও, নির্বাসনের অর্থ কী ?
জর্জ ওয়াশিংটনের ছবিওলা ডাকটিকেটে খোঁজ থাকবে না স্বাধীনতার
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কাছে এসো-
সাধু অ্যাবের মর্মর মূর্তিকে গণতন্ত্র আর মানবতার জন্য
মালির ঘামে ভেজা ফুলের তোড়া দিয়ো না-
নিহত লোকটি লজ্জায় ঘৃণায় আবার আত্মহত্যা করবে।
বারবারা এসো,
রবিশঙ্করের সুরে সুরে মুমূর্ষু মানবতাকে গাই
বিবেকের জংধরা দরোজায় প্রবল করাঘাত করি
অন্যায়ের বিপুল হিমালয় দেখে এসে ক্রুদ্ধ হই, সংগঠিত হই
জল্লাদের শাণিত অস্ত্র
সভ্যতার নির্মল পুষ্পকে আহত করার পূর্বে,
দর্শন ও সাহিত্যকে হত্যা করার পূর্বে
এসো বারবারা বজ্র হয়ে বিদ্ধ করি তাকে।
...

Saturday, November 21, 2009

শহীদ স্মরণে / মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান

...

কবিতায় আর কি লিখব ?
যখন বুকের রক্তে লিখেছি
একটি নাম
বাংলাদেশ।
গানে আর ভিন্ন কি সুরের ব্যঞ্জনা ?
যখন হানাদারবধ সংগীতে
ঘৃণার প্রবল মন্ত্রে জাগ্রত
স্বদেশের তরুণ হাতে
নিত্য বেজেছে অবিরাম
মেশিনগান, মর্টার, গ্রেনেড।

কবিতায় কি বলব ?
যখন আসাদ
মনিরামপুরের প্রবল শ্যামল
হৃদয়ের তপ্ত রুধিরে করেছে রঞ্জিত
সারা বাংলায় আজ উড্ডীন
সেই রক্তাক্ত পতাকা।
আসাদের মৃত্যুতে আমি
অশ্রুহীন; অশোক; কেননা
নয়ন কেবল বজ্রবর্ষী; কেননা
আমার বৃদ্ধ পিতার শরীরে
এখন পশুদের প্রহারের
চিহ্ন; কেননা আমার বৃদ্ধা মাতার
কণ্ঠে নেই আর্ত হাহাকার, নেই
অভিসম্পাত- কেবল
দুর্মর ঘৃণার আগুন; কোন
সান্ত্বনাবাক্য নয়, নয় কোন
বিমর্ষ বিলাপ; তাঁকে বলি নি
'তোমার ছেলে আসল ফিরে
হাজার ছেলে হয়ে
আর কেঁদো না মা'; কেননা
মা তো কাঁদে না;
মার চোখে নেই অশ্রু, কেবল
অনলজ্বালা, দুচোখে তাঁর
শত্রুহননের আহ্বান।
আসাদের রক্তধারায় মহৎ
কবিতার, সব মহাকাব্যের,
আদি অনাদি আবেগ-
বাংলাদেশ- জাগ্রত।

আমি কবিতায় নতুন আর
কি বলব ? যখন মতিউর
করাচীর খাঁচা ছিঁড়ে ছুটে গেল
মহাশূন্যে টি-৩৩ বিমানের
দুর্দম পাখায় তার স্বপ্নের
স্বাধীন স্বদেশ মনে করে-
ফেলে তার মাহিন তুহিন মিলি
সর্বস্ব সম্পদ; পরম আশ্চর্য এক
কবিতার ইন্দ্রজাল স্রষ্টা হল,-
তার অধিক কবিতা আর
কোন বঙ্গভাষী কবে লিখেছে কোথায় ?
আমি কোন শহীদের স্মরণে লিখব ?
বায়ান্ন, বাষট্টি, উনসত্তর, একাত্তর;
বাংলার লক্ষ লক্ষ আসাদ মতিউর আজ
বুকের শোণিতে উর্বর করেছে এই
প্রগাঢ় শ্যামল।

শহীদের পুণ্য রক্তে সাত কোটি
বাঙালির প্রাণের আবেগ আজ
পুষ্পিত সৌরভ। বাংলার নগর, বন্দর,
গঞ্জ, বাষট্টি হাজার গ্রাম
ধ্বংসস্তূপের থেকে সাত কোটি ফুল
হয়ে ফোটে। প্রাণময় মহৎ কবিতা
আর কোথাও দেখি না এর চেয়ে।
শব্দভুক পদ্যব্যবসায়ী ভীরু বঙ্গজ পুঙ্গব সব
এই মহাকাব্যের কাননে খোঁজে
নতুন বিস্ময়। (কলমের সাথে আজ
কবির দুর্জয় হাতে নির্ভুল স্টেনগান কথা বলে।)

কবিতায় আর নতুন কি লিখব
যখন বুকের রক্তে
লিখেছি একটি নাম
বাংলাদেশ।
...

বারবার ফিরে আসে / শামসুর রাহমান

...

বার বার ফিরে আসে রক্তাপ্লুত শার্ট
ময়দানে ফিরে আসে, ব্যাপক নিসর্গে ফিরে আসে,
ফিরে আসে থমথমে শহরের প্রকাণ্ড চোয়ালে।
হাওয়ায় হাওয়ায় ওড়ে, ঘোরে হাতে হাতে,
মিছিলে পতাকা হয় বারবার রক্তাপ্লুত শার্ট।
বিষম দামাল দিনগুলি ফিরে আসে বারবার,
বারবার কল্লোলিত আমাদের শহর ও গ্রাম।

'আবার আসবো ফিরে' ব'লে সজীব কিশোর
শার্টের আস্তিন দ্রুত গোটাতে গোটাতে
             শ্লোগানের নিভাঁজ উল্লাসে
বারবার মিশে যায় নতুন মিছিলে, ফেরে না যে আর।
একটি মায়ের চোখ থেকে
করুণ প্লাবন মুছে যেতে না যেতেই
আরেক মায়ের চোখ শ্রাবণের অঝোরে আকাশ হ'য়ে যায়।
একটি বধূর
সংসার উজাড়-করা হাহাকার থামতে না থামতেই, হায়,
আরেক বধূর বুক খাঁ-খাঁ গোরস্থান হ'য়ে যায়,
একটি পিতার হাত থেকে কবরের কাঁচা মাটি
             ঝ'রে পড়তে না পড়তেই
আরেক পিতার বুক-শূন্য-করা গুলিবিদ্ধ সন্তানের লাশ
             নেমে যায় নীরন্ধ্র কবরে।

সংগ্রাম চলবেই / সিকান্দার আবু জাফর

...

জনতার সংগ্রাম চলবেই,
আমাদের সংগ্রাম চলবেই।

হতমানে অপমানে নয়, সুখ সম্মানে
বাঁচবার অধিকার কাড়তে
দাস্যের নির্মোক ছাড়তে
অগণিত মানুষের প্রাণপণ যুদ্ধ
চলবেই চলবেই,
আমাদের সংগ্রাম চলবেই।

প্রতারণা প্রলোভন প্রলেপে
হ'ক না আঁধার নিশ্ছিদ্র
আমরা তো সময়ের সারথী
নিশিদিন কাটাবো বিনিদ্র।

দিয়েছি তো শান্তি আরও দেবো স্বস্তি
দিয়েছি তো সম্ভ্রম আরও দেবো অস্থি
প্রয়োজন হ'লে দেবো একনদী রক্ত।
হ'ক না পথের বাধা প্রস্তর শক্ত,
অবিরাম যাত্রার চির সংঘর্ষে
একদিন সে-পাহাড় টলবেই।
চলবেই চলবেই
আমাদের সংগ্রাম চলবেই

মৃত্যুর ভর্ৎসনা আমরা তো অহরহ শুনছি
আঁধার গোরের ক্ষেতে তবু তো' ভোরের বীজ বুনছি।
আমাদের বিক্ষত চিত্তে
জীবনে জীবনে অস্তিত্বে
কালনাগ-ফণা উৎক্ষিপ্ত
বারবার হলাহল মাখছি,
তবু তো ক্লান্তিহীন যত্নে
প্রাণে পিপাসাটুকু স্বপ্নে
প্রতিটি দণ্ডে মেলে রাখছি।
আমাদের কি বা আছে
কি হবে যে অপচয়,
যার সর্বস্বের পণ
কিসে তার পরাজয় ?
বন্ধুর পথে পথে দিনান্ত যাত্রী
ভূতের বাঘের ভয়
সে তো আমাদের নয়।

হতে পারি পথশ্রমে আরও বিধ্বস্ত
ধিকৃত নয় তবু চিত্ত
আমরা তো সুস্থির লক্ষ্যের যাত্রী
চলবার আবেগেই তৃপ্ত।
আমাদের পথরেখা দুস্তর দুর্গম
সাথে তবু অগণিত সঙ্গী
বেদনার কোটি কোটি অংশী
আমাদের চোখে চোখে লেলিহান অগ্নি
সকল বিরোধ-বিধ্বংসী।
এই কালো রাত্রির সুকঠিন অর্গল
কোনোদিন আমরা যে ভাঙবোই
মুক্ত প্রাণের সাড়া জানবোই,
আমাদের শপথের প্রদীপ্ত স্বাক্ষরে
নূতন সূর্যশিখা জ্বলবেই।
চলবেই চলবেই
আমাদের সংগ্রাম চলবেই।
...

মাতৃভূমির জন্য / সৃজন সেন

...

আমার বয়স তখন কতোই বা !
চার কিংবা পাঁচ।
অথচ আমার স্মৃতিকে আজও অন্ধকার করে দেয়
সেই সময়ের এক রাশ কালো ধোঁয়া
কুণ্ডলী পাকিয়ে পাকিয়ে যে ধোঁয়া-
আকাশে মিলিয়ে যাচ্ছিল,
আমাদের বাড়ির শেষপ্রান্তে
বুড়ো বটগাছটার নিচে দাঁড়িয়ে
সবাই ভিড় করে সেই ধোঁয়া দেখছিল,
আমিও মায়ের কোলে চড়ে সেই ধোঁয়া দেখছিলাম,
সবাই আতঙ্কে 'রায়ট লাগছে, রায়ট লাগছে' বলে
ছোটাছুটি করছিল

কখনো আমার মাকে / শামসুর রাহমান

...

কখনো আমার মাকে কোনো গান গাইতে শুনিনি।
সেই কবে শিশু রাতে ঘুম পাড়ানিয়া গান গেয়ে
আমাকে কখনো ঘুম পাড়াতেন কি না আজ মনেই পড়ে না।

যখন শরীরে তার বসন্তের সম্ভার আসেনি,
যখন ছিলেন তিনি ঝড়ে আম-কুড়িয়ে বেড়ানো
বয়সের কাছাকাছি হয়তো তখনো কোনো গান
লতিয়ে ওঠেনি মীড়ে মীড়ে দুপুরে সন্ধ্যায়,
পাছে গুরুজনদের কানে যায়। এবং স্বামীর

সংসারে এসেও মা আমার সারাক্ষণ
ছিলেন নিশ্চুপ বড়ো, বড়ো বেশি নেপথ্যচারিণী। যতদূর
জানা আছে, টপ্পা কি খেয়াল তাঁকে করেনি দখল
কোনোদিন। মাছ কোটা কিংবা হলুদ বাটার ফাঁকে
অথবা বিকেলবেলা নিকিয়ে উঠোন
ধুয়ে মুছে বাসন-কোসন
সেলাইয়ের কলে ঝুঁকে, আলনায় ঝুলিয়ে কাপড়,
ছেঁড়া শার্টে রিফু কর্মে মেতে
আমাকে খেলার মাঠে পাঠিয়ে আদরে
অবসরে চুল বাঁধবার ছলে কোনো গান গেয়েছেন কি না
এতকাল কাছাকাছি আছি তবু জানতে পারিনি।

যেন তিনি সব গান দুঃখ-জাগানিয়া কোনো কাঠের সিন্দুকে
রেখেছেন বন্ধ ক'রে আজীবন, এখন তাদের
গ্রন্থিল শরীর থেকে কালেভদ্রে সুর নয়, শুধু
ন্যাপথলিনের তীব্র ঘ্রাণ ভেসে আসে !
...

তুমি বলেছিলে / শামসুর রাহমান

...

দাউ দাউ পুড়ে যাচ্ছে নতুন বাজার।
পুড়ছে দোকান-পাট, কাঠ,
লোহা-লক্কড়ের স্তূপ, মসজিদ এবং মন্দির।
দাউ দাউ পুড়ে যাচ্ছে নতুন বাজার।

বিষম পুড়ছে চতুর্দিকে ঘর-বাড়ি।
পুড়ছে টিয়ের খাঁচা, রবীন্দ্র রচনাবলি, মিষ্টান্ন ভাণ্ডার,
মানচিত্র, পুরনো দলিল।
মৌচাকে আগুন দিলে যেমন সশব্দে
সাধের আশ্রয় ত্যাগী হয়
মৌমাছির ঝাঁক,
তেমনি সবাই
পালাচ্ছে শহর ছেড়ে দিগ্বিদিক। নবজাতককে
বুকে নিয়ে উদ্ভ্রান্ত জননী
বনপোড়া হরিণীর মত যাচ্ছে ছুটে।
অদূরে গুলির শব্দ, রাস্তা চষে জঙ্গী জীপ। আর্ত
শব্দ সবখানে। আমাদের দু'জনের
মুখে খরতাপ। আলিঙ্গনে থরো থরো
তুমি বলেছিলে,
‌'আমাকে বাঁচাও এই বর্বর আগুন থেকে, আমাকে বাঁচাও,
আমাকে লুকিয়ে ফেলো চোখের পাতায়
বুকের অতলে কিংবা একান্ত পাঁজরে
আমাকে নিমেষে শুষে নাও
চুম্বনে চুম্বনে।'

দাউ দাউ পুড়ে যাচ্ছে নতুন বাজার,
আমাদের চৌদিকে আগুন,
গুলির ইস্পাতী শিলাবৃষ্টি অবিরাম।
তুমি বলেছিলে
আমাকে বাঁচাও।
অসহায় আমি তাও বলতে পারিনি।
...

স্বাধীনতা তুমি / শামসুর রাহমান

...

স্বাধীনতা তুমি
রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান।
স্বাধীনতা তুমি
কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো
মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা-
স্বাধীনতা তুমি
শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভা
স্বাধীনতা তুমি
পতাকা-শোভিত শ্লোগান-মুখর ঝাঁঝালো মিছিল।
স্বাধীনতা তুমি
ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি।
স্বাধীনতা তুমি
রোদেলা দুপুরে মধ্যপুকুরে গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতার।
স্বাধীনতা তুমি
মজুর যুবার রোদে ঝলসিত দক্ষ বাহুর গ্রন্থিল পেশী।
স্বাধীনতা তুমি
অন্ধকারের খাঁ খাঁ সীমান্তে মুক্তিসেনার চোখের ঝিলিক।
স্বাধীনতা তুমি
বটের ছায়ায় তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থীর
শানিত কথার ঝলসানি-লাগা সতেজ ভাষণ।
স্বাধীনতা তুমি
চা-খানায় আর মাঠে-ময়দানে ঝোড়ো সংলাপ।
স্বাধীনতা তুমি
কালবোশেখীর দিগন্তজোড়া মত্ত ঝাপটা।
স্বাধীনতা তুমি
শ্রাবণে অকূল মেঘনার বুক
স্বাধীনতা তুমি পিতার কোমল জায়নামাজের উদার জমিন।
স্বাধীনতা তুমি
উঠানে ছড়ানো মায়ের শুভ্র শাড়ির কাঁপন।
স্বাধীনতা তুমি
বোনের হাতের নম্র পাতায় মেহেদীর রঙ।
স্বাধীনতা তুমি বন্ধুর হাতে তারার মতন জ্বলজ্বলে এক রাঙা পোস্টার।
স্বাধীনতা তুমি
গৃহিণীর ঘন খোলা কালো চুল,
হাওয়ায় হাওয়ায় বুনো উদ্দাম।
স্বাধীনতা তুমি
খোকার গায়ের রঙিন কোর্তা,
খুকীর অমন তুলতুলে গালে
রৌদ্রের খেলা।
স্বাধীনতা তুমি
বাগানের ঘর, কোকিলের গান,
বয়েসী বটের ঝিলিমিলি পাতা,
যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা।
...

একুশে ফেব্রুয়ারি / আবদুল গাফফার চৌধুরী

...

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু-গড়া এ ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি।

জাগো নাগিনীরা জাগো নাগিনীরা জাগো কালবোশেখীরা
শিশুহত্যার বিক্ষোভে আজ কাঁপুক বসুন্ধরা,
দেশের সোনার ছেলে খুন করে রোখে মানুষের দাবী
দিন বদলের ক্রান্তি লগনে তবু তোরা পার পারি ?
না, না, না, না খুন রাঙা ইতিহাসে শেষ রায় দেওয়া তারই
একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।

সেদিনো এমনি নীল গগনের বসনে শীতের শেষে
রাত জাগা চাঁদ চুমো খেয়েছিলো হেসে;
পথে পথে ফোটে রজনীগন্ধা অলকানন্দা যেনো,
এমন সময ঝড় এলো এক, ঝড় এলো ক্ষ্যাপা বুনো।
সেই আঁধারে পশুদের মুখ চেনা
তাহাদের তরে মায়ের, বোনের, ভায়ের চরম ঘৃণা
ওরা গুলি ছোঁড়ে এদেশের প্রাণে দেশের দাবীকে রোখে
ওদের ঘৃণ্য পদাঘাত এই বাংলার বুকে।
ওরা এদেশের নয়,
দেশের ভাগ্য ওরা করে বিক্রয়-
ওরা মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শান্তি নিয়েছে কাড়ি-
একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।

তুমি আজ জাগো তুমি আজ জাগো একুশে ফেব্রুয়ারি
আজো জালিমের কারাগারে মরে বীর ছেলে বীর নারী
আমার শহীদ ভাইয়ের আত্মা ডাকে
জাগে মানুষের সুপ্ত শক্তি হাটে মাঠে ঘাটে বাঁকে
দারুণ ক্রোধের আগুনে জ্বালবো ফেব্রুয়ারি
একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।
...

নোলক / আল মাহমুদ

...

    আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেল শেষে
    হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে।
    নদীর কাছে গিয়েছিলাম, আছে তোমার কাছে ?
    -হাত দিওনা আমার শরীর ভরা বোয়াল মাছে।
    বললো কেঁদে তিতাস নদী হরিণবেড়ের বাঁকে
    শাদা পালক বকরা যেথায় পাখ ছড়িয়ে থাকে।

    জল ছাড়িয়ে দল হারিয়ে গেলাম বনের দিক
    সবুজ বনের হরিৎ টিয়ে করে রে ঝিকমিক।
    বনের কাছে এই মিনতি, ফিরিয়ে দেবে ভাই,
    আমার মায়ের গয়না নিয়ে ঘরকে যেতে চাই।

    কোথায় পাবো তোমার মায়ের হারিয়ে যাওয়া ধন
    আমরা তো সব পাখপাখালি বনের সাধারণ।
    সবুজ চুলে ফুল পিন্দেছি নোলক পরি নাতো !
    ফুলের গন্ধ চাও যদি নাও, হাত পাতো হাত পাতো
    বলে পাহাড় দেখায় তাহার আহার ভরা বুক
    হাজার হরিণ পাতার ফাঁকে বাঁকিয়ে রাখে মুখ।
    এলিয়ে খোঁপা রাত্রি এলেন, ফের বাড়ালাম পা
    আমার মায়ের গয়না ছাড়া ঘরকে যাবো না।
...

পাখির মতো / আল মাহমুদ

...

    আম্মা বলেন, পড়রে সোনা
               আব্বা বলেন, মন দে;
    পাঠে আমার মন বসে না
               কাঁঠালচাঁপার গন্ধে।

    আমার কেবল ইচ্ছে জাগে
               নদীর কাছে থাকতে,
    বকুল ডালে লুকিয়ে থেকে
               পাখির মতো ডাকতে।

    সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে
               কর্ণফুলীর কূলটায়,
    দুধভরা ঐ চাঁদের বাটি
               ফেরেস্তারা উল্টায়।

    তখন কেবল ভাবতে থাকি
               কেমন করে উড়বো,
    কেমন করে শহর ছেড়ে
               সবুজ গাঁয়ে ঘুরবো !

    তোমরা যখন শিখছো পড়া
               মানুষ হওয়ার জন্য,
    আমি না হয় পাখিই হবো,
               পাখির মতো বন্য।
..

ঊনসত্তরের ছড়া- ১ / আল মাহমুদ

...

    ট্রাক ! ট্রাক ! ট্রাক !
    শুয়োরমুখো ট্রাক আসবে
    দুয়োর বেঁধে রাখ।

    কেন বাঁধবো দোর জানালা
    তুলবো কেন খিল ?
    আসাদ গেছে মিছিল নিয়ে
    ফিরবে সে মিছিল।

    ট্রাক ! ট্রাক ! ট্রাক !
    ট্রাকের মুখে আগুন দিতে
    মতিয়ুরকে ডাক।

    কোথায় পাবো মতিয়ুরকে
    ঘুমিয়ে আছে সে !
    তোরাই তবে সোনামানিক
    আগুন জ্বেলে দে।
...

একুশের কবিতা / আল মাহমুদ

...

    ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ
           দুপুর বেলার অক্ত
    বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায় ?
           বরকতের রক্ত।

    হাজার যুগের সূর্যতাপে
           জ্বলবে এমন লাল যে,
    সেই লোহিতেই লাল হয়েছে
           কৃষ্ণচূড়ার ডাল যে !

    প্রভাতফেরীর মিছিল যাবে
           ছড়াও ফুলের বন্যা
    বিষাদগীতি গাইছে পথে
           তিতুমীরের কন্যা।

    চিনতে না কি সোনার ছেলে
           ক্ষুদিরামকে চিনতে ?
    রুদ্ধশ্বাসে প্রাণ দিলো যে
           মুক্ত বাতাস কিনতে ?

    পাহাড়তলীর মরণ চূড়ায়
           ঝাঁপ দিল যে অগ্নি,
    ফেব্রুয়ারির শোকের বসন
           পরলো তারই ভগ্নী।

    প্রভাতফেরী, প্রভাতফেরী
           আমায় নেবে সঙ্গে,
    বাংলা আমার বচন, আমি
           জন্মেছি এই বঙ্গে।
..

হায়রে মানুষ / আল মাহমুদ

...

    একটু ছিল বয়েস যখন ছোট্ট ছিলাম আমি
    আমার কাছে খেলাই ছিল কাজের চেয়ে দামি।
    উঠোন জুড়ে ফুল ফুটেছে আকাশ ভরা তারা
    তারার দেশে উড়তো আমার পরাণ আত্মহারা।
    জোছনা রাতে বুড়িগঙ্গা তুলতো যখন ঢেউ
    আমার পিঠে পরীর ডানা পরিয়ে দিতো কেউ।
    দেহ থাকতো এই শহরে উড়াল দিতো মন
    মেঘের ছিটার ঝিলিক পেয়ে হাসতো দু’নয়ন।
    তারায় তারায় হাঁটতো আমার ব্যাকুল দু’টি পা
    নীল চাঁদোয়ার দেশে হঠাৎ রাত ফুরাতো না।
    খেলার সাথী ছিল তখন প্রজাপতির ঝাঁক
    বনভাদালির গন্ধে কত কুটকুটোতো নাক;
    কেওড়া ফুলের ঝোল খেয়ে যে কোল ছেড়েছে মা’র
    তার কি থাকে ঘরবাড়ি না তার থাকে সংসার ?

    তারপরে যে কী হলো, এক দৈত্য এসে কবে
    পাখনা দুটো ভেঙে বলে মানুষ হতে হবে।
    মানুষ হওয়ার জন্য কত পার হয়েছি সিঁড়ি
    গাধার মত বই গিলেছি স্বাদ যে কি বিচ্ছিরি।
    জ্ঞানের গেলাস পান করে আজ চুল হয়েছে শণ
    কেশের বাহার বিরল হয়ে উজাড় হলো বন।
    মানুষ মানুষ করে যারা মানুষ তারা কে ?
    অফিস বাড়ির মধ্যে রোবোট কলম ধরেছে।
    নরম গদি কোশন আসন চশমা পরা চোখ
    লোক ঠকানো হিসেব লেখে, কম্প্যুটারে শ্লোক।
    বাংলাদেশের কপাল পোড়ে ঘূর্ণিঝড়ে চর
    মানুষ গড়ার শাসন দেখে বুক কাঁপে থরথর।
    ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’- গান শোননি ভাই ?
    মানুষ হবার ইচ্ছে আমার এক্কেবারে নাই।
...

অবাক সূর্যোদয় / হাসান হাফিজুর রহমান

...

কিশোর তোমার দুই
হাতের তালুতে আকুল সূর্যোদয়
রক্তভীষণ মুখমণ্ডলে চমকায় বরাভয় ।
বুকের অধীর ফিনকির ক্ষুরধার
শহীদের খুন লেগে
কিশোর তোমার দুই হাতে দুই
সূর্য উঠেছে জেগে ।
মানুষের হাতে অবাক সূর্যোদয়,
যায় পুড়ে যায় মর্ত্যের অমানিশা
শঙ্কার সংশয় ।

কিশোর তোমার হাত দুটো উঁচু রাখো
প্রবল অহংকারে সূর্যের সাথে
অভিন্ন দেখ অমিত অযুত লাখ ।
সারা শহরের মুখ
তোমার হাতের দিকে
ভয়হারা কোটি অপলক চোখ একাকার হল
সূর্যের অনিমিখে ।

কিশোর তোমার হাত দুটো উঁচু রাখো
লোলিত পাপের আমূল রসনা ক্রুর অগ্নিতে ঢাক ।
রক্তের খরতানে
জাগাও পাবক প্রাণ
কণ্ঠে কাটাও নিষ্ঠুরতম গান
যাক পুড়ে যাক আপামর পশু
মনুষ্যত্বের ধিক্ অপমান
কিশোর তোমার হাত দুটো উঁচু রাখো
কুহেলী পোড়ানো মিছিলের হুতাশনে
লাখ অযুতকে ডাক ।

কিশোর তোমার দুই
হাতের তালুতে আকূল সূর্যোদয়
রক্তশোধিত মুখমণ্ডলে চমকাক্ বরাভয় ।
...

স্মৃতিস্তম্ভ / আলাউদ্দিন আল আজাদ

...

স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার ? ভয় কি বন্ধু, আমরা এখনো
          চারকোটি পরিবার
খাড়া রয়েছি তো ! যে-ভিত কখনো কোনো রাজন্য
          পারেনি ভাঙতে
হীরের মুকুট নীল পরোয়ানা খোলা তলোয়ার
খুরের ঝটকা ধুলায় চূর্ণ যে পদ-প্রান্তে
          যারা বুনি ধান
গুণ টানি, আর তুলি হাতিয়ার হাঁপর চালাই
সরল নায়ক আমরা জনতা সেই অনন্য ।
           ইটের মিনার
ভেঙেছে ভাঙুক ! ভয় কি বন্ধু, দেখ একবার আমরা জাগরী
           চারকোটি পরিবার ।

এ-কোন মৃত্যু ? কেউ কি দেখেছে মৃত্যু এমন,
শিয়রে যাহার ওঠেনা কান্না, ঝরেনা অশ্রু ?
হিমালয় থেকে সাগর অবধি সহসা বরং
সকল বেদনা হয়ে ওঠে এক পতাকার রং
এ-কোন মৃত্যু ? কেউ কি দেখেছে মৃত্যু এমন,
বিরহে যেখানে নেই হাহাকার ? কেবল সেতার
হয় প্রপাতের মোহনীয় ধারা, অনেক কথার
পদাতিক ঋতু কলমেরে দেয় কবিতার কাল ?
ইটের মিনার ভেঙেছে ভাঙুক । একটি মিনার গড়েছি আমরা
           চারকোটি কারিগর
বেহালার সুরে, রাঙা হৃদয়ের বর্ণলেখায় ।
           পলাশের আর
রামধনুকের গভীর চোখের তারায় তারায়
দ্বীপ হয়ে ভাসে যাদের জীবন, যুগে যুগে সেই
            শহীদের নাম
এঁকেছি প্রেমের ফেনিল শিলায়, তোমাদের নাম ।
            তাই আমাদের
হাজার মুঠির বজ্র শিখরে সূর্যের মতো জ্বলে শুধু এক
            শপথের ভাস্কর ।
...

Friday, November 20, 2009

এমন যদি হতো / সুকুমার বড়ুয়া

...

এমন যদি হতো
ইচ্ছে হলে আমি হতাম
প্রজাপতির মতো
নানান রঙের ফুলের পরে
বসে যেতাম চুপটি করে
খেয়াল মতো নানান ফুলের
সুবাস নিতাম কতো ।

এমন হতো যদি
পাখি হয়ে পেরিয়ে যেতাম
কত পাহাড় নদী
দেশ বিদেশের অবাক ছবি
এক পলকের দেখে সবই
সাতটি সাগর পাড়ি দিতাম
উড়ে নিরবধি ।

এমন যদি হয়
আমায় দেখে এই পৃথিবীর
সবাই পেতো ভয়
মন্দটাকে ধ্বংস করে
ভালোয় দিতাম জগৎ ভরে
খুশির জোয়ার বইয়ে দিতাম
এই দুনিয়াময় ।

এমন হবে কি ?
একটি লাফে হঠাৎ আমি
চাঁদে পৌঁছেছি !
গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে
দেখে শুনে ভালো করে
লক্ষ যুগের অন্ত আদি
জানতে ছুটেছি ।
...

ঠিক আছে / সুকুমার বড়ুয়া

...

অসময়ে মেহমান
ঘরে ঢুকে বসে যান
বোঝালাম ঝামেলার
যতগুলো দিক আছে
তিনি হেসে বললেন
          ঠিক আছে ঠিক আছে ।

রেশনের পচা চাল
টলটলে বাসি ডাল
থালাটাও ভাঙা-চোরা
বাটিটাও লিক আছে
খেতে বসে জানালেন
          ঠিক আছে ঠিক আছে ।

মেঘ দেখে মেহমান
চাইলেন ছাতাখান
দেখালাম ছাতাটার
শুধু কটা শিক আছে
তবু তিনি বললেন
          ঠিক আছে ঠিক আছে ।
...

হাঁটি হাঁটি পা পা / এখলাসউদ্দিন আহমদ

...

এক পা যেতে
তিন পা টলে
        দুই পা যেতে ঝুপ ।
তিন পা যেতে
এক পা টলে
         পাঁচ পা যেতেই চুপ !
ছয় পা যেতে
আর টলে না
          কেবল হাঁটাহাটি !
তেলের শিশি
উলটে ফেলে
          ঘরসংসার মাটি ।
হাঁটি হাঁটি পা পা
যেখানে খুশি সেখানে যা ।
...

যাবোই যাবো মাগো / এখলাসউদ্দিন আহমদ

...

এবার আমি যাবোই যাবো মাগো
পেরিয়ে সাত সাগর তেপান্তর
আমার উপর যতোই তুমি রাগো
এমন দিনে থাকবো না আর ঘর।

আকাশ নীলে আমার পক্ষীরাজ
ছুটবে বেগে ঝড়ের পাশে পাশে
সামনে পিছে ঘন মেঘের বাজ
জয়ধ্বনি দেবে মা উল্লাসে।

পেছন হতে যে যাই করুক মানা
দেখাক না ভয় দত্যি-দানোর বেশে
আজকে আমি শুনবো নাকো মানা
যাবোই যাবো ঘুমপরীদের দেশে।

সেথায় গিয়ে গাইবো আমি মাগো
তুফান সুরে ঘুমভাঙানী গান
বলবো হেঁকে দস্যু দামাল জাগো
বুলবুলিরা নিচ্ছে লুটে ধান।

নতুন সুরে উঠবে সবাই কাঁপি
ঘুমপরীরা ভুলবে রাতের ঘুম
ছিনিয়ে নিয়ে ঘুমঢুলুনির ঝাঁপি
বলবো হেঁকে আর নেবো না চুম।

শুনবো না আর ঘুমপাড়ানী ছড়া
গাইবো এবার ঘুমভাঙানী গান
বুলবুলিদের বাঁধবো কষে দড়া
আর দেবো না সোনার আমন ধান।
...

কফিন কাহিনী / মহাদেব সাহা

...

চারজন দেবদূত এসে ঘিরে আছে একটি কফিন
একজন বললো দেখো ভিতরে রঙিন
রক্তমাখা জামা ছিলো হয়ে গেছে ফুল
চোখ দুটি মেঘে মেঘে ব্যথিত বকুল !

চারজন দেবদূত এসে ঘিরে আছে এক শবদেহ
একজন বললো দেখো ভিতরে সন্দেহ
যেমন মানুষটি ছিলো মানুষটি নাই
মাটির মানচিত্র হয়ে ফুটে আছে তাই !

চারজন দেবদূত এসে ঘিরে আছে একটি শরীর
একজন বললো দেখো ভিতরে কী স্থির
মৃত নয়, দেহ নয়, দেশ শুয়ে আছে
সমস্ত নদীর উৎস হৃদয়ের কাছে !

চারজন দেবদূত এসে ঘিরে আছে একটি কফিন
একজন বললো দেখো ভিতরে নবীন
হাতের আঙুলগুলি আরক্ত করবী
রক্তমাখা বুক জুড়ে স্বদেশের ছবি !
...
১৯৭৬

তিনি এসেছেন ফিরে / শামসুর রাহমান

...

লতাগুল্ম, বাঁশঝাড়, বাবুই পাখির বাসা আর
মধুমতি নদীটির বুক থেকে বেদনাবিহ্বল
ধ্বনি উঠে মেঘমালা ছুঁয়ে
ব্যাপক ছড়িয়ে পড়ে সারা বাংলায়।

এখন তো তিনি নেই, তবু সেই ধ্বনি আজ শুধু
তাঁরই কথা বলে;
মেঘনা নদীর মাঝি যখন নদীতে
ভাটিয়ালী সুর তোলে, তার
পালে লাগে দীর্ঘদেহী সেই পুরুষের দীর্ঘশ্বাস,
যখন কৃষক কাস্তে হাতে
ফসলের যৌবনের উদ্ভিন্ন উল্লাস দেখে মাতে,
তখন মহান সেই পুরুষের বিপুল আনন্দধ্বনি ঝরে
ফসলের মাঠে,
যখন কুমোর গড়ে মাটির কলস, ঘটিবাটি,
নানান পুতুল চাকা ঘোরাতে ঘোরাতে,
তখন সৃজনশিল্পে তার
জেগে ওঠে মহান নেতার স্বপ্নগুলি,
উচ্ছ্বসিত লাউডগা, কচুপাতা, কুয়োতলা, পোয়াতি
কুমোর বউ।

ওরা তাঁকে হত্যা ক'রে ভেবেছিল তিনি
সহজে হবেন লুপ্ত উর্ণাজাল আর ধোঁয়াশায়,
মাটি তাঁকে দেবে চাপা বিস্মৃতির জন্মান্ধ পাতালে-
কিন্তু তিনি আজ সগৌরবে
এসেছেন ফিরে দেশপ্রেমিকের দীপ্র উচ্চারণে,
সাধারণ মানুষের প্রখর চৈতন্যে,
শিল্পীর তুলিতে, গায়কের গানে, কবির ছন্দের
আন্দোলনে,
রৌদ্রঝলসিত পথে মহামিছিলের পুরোভাগে।
...

মেঘ ছেড়েছে ঘর / হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী

...

জল ভর ভর মেঘ ছেড়েছে ঘর
মেঘ ছুঁয়েছে আকাশবাড়ি
ভিজলো জলে নীলের শাড়ি
বৃষ্টি ছুঁলো বনবনানী দিগন্ত প্রান্তর
মন ভর ভর মেঘ ছেড়েছে ঘর

হাওয়ায় চড়ে কোথায় যাবে মেঘ
ধানের চারা দেয় ইশারা
বৃষ্টি তাতে দেয় যে সাড়া
মেঘ ছোটালো তাই কি হাওয়ার বেগ

বাদলা দিনে কোথায় যাবে মেঘ !
...

শুভেচ্ছা / হুমায়ুন আজাদ

...

ভালো থেকো ফুল, মিষ্টি বকুল, ভালো থেকো।
ভালো থেকো ধান, ভাটিয়ালি গান, ভালো থেকো।
ভালো থেকো মেঘ, মিটিমিটি তারা
ভালো থেকো পাখি, সবুজ পাতারা
ভালো থেকো চর, ছোটো কুঁড়েঘর, ভালো থেকো।
ভালো থেকো চিল, আকাশের নীল, ভালো থেকো।
ভালো থেকো পাতা, নিশির শিশির
ভালো থেকো জল, নদীটির তীর
ভালো থেকো গাছ, পুকুরের মাছ, ভালো থেকো
ভালো থেকো কাক, ডাহুকের ডাক, ভালো থেকো।
ভালো থেকো মাঠ, রাখালের বাঁশি
ভালো থেকো লাউ, কুমড়োর হাসি
ভালো থেকো আম, ছায়াঢাকা গ্রাম, ভালো থেকো।
ভালো থেকো ঘাস, ভোরের বাতাস, ভালো থেকো।
ভালো থেকো রোদ, মাঘের কোকিল
ভালো থেকো বক, আড়িয়ল বিল
ভালো থেকো নাও, মধুমাখা গাঁও, ভালো থেকো।
ভালো থেকো মেলা, লাল ছেলেবেলা, ভালো থেকো।
ভালো থেকো, ভালো থেকো, ভালো থেকো।
...

কখনো আমি / হুমায়ুন আজাদ

...

কখনো আমি স্বপ্ন দেখি যদি
স্বপ্ন দেখবো একটি বিশাল নদী।
নদীর ওপর আকাশ ঘন নীল
নীলের ভেতর উড়ছে গাঙচিল।
আকাশ ছুঁয়ে উঠছে কেবল ঢেউ
আমি ছাড়া চারদিকে নেই কেউ।

কখনো আমি কাউকে যদি ডাকি
ডাকবো একটি কোমল সুদূর পাখি।
পাখির ডানায় আঁকা বনের ছবি
চোখের তারায় জ্বলে ভোরের রবি।
আকাশ কাঁপে পাখির গলার সুরে
বৃষ্টি নামে সব পৃথিবী জুড়ে।
...

ও মেঘ / সাজ্জাদ হুসাইন

...

ও মেঘ ! আমায় সত্যি করে
তোর ঠিকানা বল-
কোত্থেকে তুই পাসরে এতো
স্নিগ্ধ-শীতল জল ?

মিষ্টি পায়ে তোর কি আছে
নূপুর, হীরের মল-
তোর বাড়িতে বাস করে কি
নৃত্য-মেয়ের দল ?

বিজলি পেলো কোথায় অমন
রঙিন আলোর ঢল-
আমায় দে-না তোর পরিচয়
করিসনে আর ছল।

তোর কথা আজ যতই ভাবি
পাই না খুঁজে তল-
মেঘ ; আমাকে বিষ্টি করে
সঙ্গে নিয়ে চল।
...

আমার কিছু কষ্ট ছিলো / রণদীপম বসু

...

আমার একটা আকাশ ছিলো
সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে
সারা দুপুর উড়ে উড়ে
আকাশটাকে আলতো ছেটে
ভাঁজ করে নিই বুকপকেটে
কেউ জানেনা পকেটে এক স্বপ্ন ছিলো।

আমার কিছু জোছনা ছিলো
সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে
জোনাক রাতে ঘুরে ঘুরে
জোছনাগুলো মেখে নিতাম
শরীরটাকে ডুবিয়ে নিতাম
কেউ জানেনা বুকের ভেতর কষ্ট ছিলো।

আমার একটা নদী ছিলো
সবাই যখন ঘুমের পাড়ে
হারিয়ে যেতো চুপিসারে
তখন আমি-
নদীটাকে ঘুম পাড়াতাম
কেউ জানেনা চোখের তারায় বৃষ্টি ছিলো।

আমার কিছু দুঃখ ছিলো
কেউ জানেনা কখন কেমন
দুঃখরা সব বৃষ্টি হয়ে
সবুজ পাতায় ছড়িয়ে গেলো।
...
(০৩/১২/২০০৬)

শৈশব / সাজ্জাদ হুসাইন

...

রূপকথা, ছড়া আর
অদেখা ঠাকুরমার-
ঝুলি ভরা গল্পের, কল্পের বই-সব-

কিছু নেই
তাকাতেই পিছু-ভাবি কই-সব
ফেলে আসা
ভাসা-ভাসা, স্মৃতি জুড়ে শৈশব!

ভরা-গাঙে লাফ-ঝাঁপ
বরষার টুপটাপ
পুকুরের তাজা কই, উনুনের খই-সব-

কিছু নেই
তাকাতেই পিছু-ভাবি কই-সব
ফেলে আসা
ভাসা-ভাসা, স্মৃতি জুড়ে শৈশব!

খেজুরের মধু-রস
পাকা আম টসটস
এলোমেলো হাঁটা-পথ, খাঁটি মাঠা-দই সব-

কিছু নেই
তাকাতেই পিছু-ভাবি কই-সব
ফেলে আসা
ভাসা-ভাসা, স্মৃতি জুড়ে শৈশব!

প্রজাপতি সেই মন
ছুটে চলা প্রতিক্ষণ
বড় হওয়া মাছে-ভাতে, গাছে ওঠা মই-সব-

কিছু নেই
তাকাতেই পিছু-ভাবি কই-সব
ফেলে আসা
ভাসা-ভাসা, স্মৃতি জুড়ে শৈশব!

জোছনায় ভেজা-রাত
কত ফাঁকি, অজুহাত
হাসি-খুশি থইথই, প্রিয় হইচই-সব-

কিছু নেই
তাকাতেই পিছু-ভাবি কই-সব
ফেলে আসা
ভাসা-ভাসা, স্মৃতি জুড়ে শৈশব!
...

কৃষ্ণচূড়ার কাছে / সুজন বড়ুয়া

...

কৃষ্ণচূড়া তোমার এ নাম কে দিয়েছে , কে ?
মিশকালো না হয়ে যদি লাল হয়ে ফুটবে,
আলতা রঙে এমন যদি সাজবেই বারবার,
তোমার কেন কৃষ্ণচূড়া নাম হয়েছে আর ?

লাল পরাগে ডাল রাঙিয়ে; রাঙিয়ে নিজের মুখ
আমার মাকে কাঁদিয়ে তোমার কেমন বলো সুখ,
কী সুখ বলো মায়ের মনে ঝলকে তুলে আজ ?
ভাই হারানো বোন হারানো আগুন-ছবির ভাঁজ।

নিজ্ঝুম এক রাতের বেলা মা দিয়েছেন ঘুম
দাদার চোখে আলোর ধাঁধা , ঘুম দিলো না চুম,
মাকে রেখে তখন আমার দাদা সূর্য সেন
পুব আকাশে উঠব বলে পশ্চিমে ডুবলেন।

প্রীতিলতা নাম শুনেছো ? সে যে আমার বোন,
রঙ তুলিতে দেশ আঁকতো, আঁকতো ঘর উঠোন,
এঁকেই তুলি ক্ষয় করেছে, জয় করেছে ভয়,
প্রীতিলতার সে সব স্মৃতি পরম প্রীতিময়।

ভাইয়ের কথা বলবো আরো, শুনবে কি তারপর ?
সবুজ মাঠে নামলো যখন জমকালো নীলকর
ধানের গানে প্রাণের বাঁশি বাজিয়ে তিতুমীর
মরণ বরণ করলো, তবু রাখলো উঁচু শির।

আমার ছিলো আর এক ভাই, জানো কি তার নাম ?
দুরন্ত সেই উড়ন্ত নীলকণ্ঠ ক্ষুদিরাম,
আগল ভাঙা পাগল হাওয়ার জন্যে বারো মাস
যুদ্ধ করে জড়িয়ে নিলো গলায় রুদ্ধশ্বাস।

আমার আরো দুই সোনা ভাই- আসাদ মতিয়ুর,
মিছিল নিয়ে পেরিয়ে গেলো রক্ত-সমুদ্দুর।
বর্ণমালায় স্বর্ণমালা গাঁথতে গেলো সেই
রফিক, সালাম কেউ আসে নি, বাড়িতে কেউ নেই।

নিঝাপ পাড়া মেঘলা দুপুর একলা আমার মা,
কৃষ্ণচূড়া লাল হয়ে আর কষ্ট দিয়ো না।
...

চাঁদের কপালে চাঁদ / সানাউল হক

...

    চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিতে এলে
    আমি যদি ধরি তারে দুই হাত মেলে
    ঘরে নিয়ে রেখে দেই কাঁথা চাপা দিয়ে
    পুলিশের লোক এসে যাবেই কি নিয়ে ?

    চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিতে এলে
    আমি যদি ধরে তারে নিয়ে যাই জেলে
    আকাশের দূত এসে হাত জোড় করে
    বলবে কি, ‘ছেড়ে দিন এইবার ওরে।’

    চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিতে এলে
    খপ করে হাত তাঁর ধরবোই ফেলে।
    বাটি ভরা দুধ-কলা দেবো তারে খেতে
    আসমানে ফিরে আর চাইবে না যেতে।

    চাঁদের কপালে চাঁদ দেয় নাতো টিপ
    এতো করে ডাকো তারে সাঁঝে জ্বেলে দীপ !
    বাগে পেলে শুধাতাম চুল ধরে তার
    ‘নেবে বলো সাজা কোন্- বন্দী এবার ?
...

সবার আমি ছাত্র / সুনির্মল বসু

...

    আকাশ আমায় শিক্ষা দিল
            উদার হতে ভাই রে,
    কর্মী হবার মন্ত্র আমি
            বায়ুর কাছে পাই রে।
    পাহাড় শিখায় তাহার সমান
    হই যেন ভাই মৌন-মহান,
    খোলা মাঠের উপদেশে-
            দিল-খোলা হই তাই রে।

    সূর্য আমায় মন্ত্রণা দেয়
            আপন তেজে জ্বলতে,
    চাঁদ শিখাল হাসতে মোরে,
            মধুর কথা বলতে।
    ইঙ্গিতে তার শিখায় সাগর,-
    অন্তর হোক রত্ন-আকর ;
    নদীর কাছে শিক্ষা পেলাম
            আপন বেগে চলতে।

    মাটির কাছে সহিষ্ণুতা
            পেলাম আমি শিক্ষা,
    আপন কাজে কঠোর হতে
            পাষাণ দিল দীক্ষা।
    ঝরনা তাহার সহজ গানে,
    গান জাগাল আমার প্রাণে,
    শ্যাম বনানী সরসতা
            আমায় দিল ভিক্ষা।

    বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর,
            সবার আমি ছাত্র,
    নানান ভাবে নতুন জিনিস
            শিখছি দিবারাত্র ;
    এই পৃথিবীর বিরাট খাতায়
    পাঠ্য যে-সব পাতায় পাতায়,
    শিখছি সে-সব কৌতূহলে
            সন্দেহ নাই মাত্র।
...

ঘুমপাড়ানি গান / সরোজিনী নাইডু

...

    মশলা-বনের আমেজ নিয়ে
    কত ধানের ক্ষেত পেরিয়ে
            পদ্মদিঘির সুবাসটুকু মেখে,
    শিশিরকণার ঝিকমিকানি -
    ছোট্ট মিঠে স্বপনখানি
            এনেছি দূর পরীর দেশের থেকে।

    খোকনমণি, ঘুমোও এবার,
    দীপ জ্বেলেছে জোনাকি তার,
            ঝাঁকে ঝাঁকে নাচছে নিমের গাছে।
    আফিম ফুলের পেয়ালা ছেঁকে
    চোরাই করে আঁচল ঢেকে
            এনেছি এই স্বপন তোমার কাছে!

    ঘুমোও আমায় বিদায় দিয়ে,
    লক্ষ তারা ঝলমলিয়ে
            তোমায় ঘিরে জ্বলছে দু’চোখ মেলে।
    আদর করে শুইয়ে ঘুমে
    সোনার জাদুর নয়ন চুমে
            স্বপন-মধু দিলেম তাতে ঢেলে।
...

একটু পেলে ছুটি / শাহাবুদ্দীন নাগরী

...

আকাশ যখন তারার বাগান হয়
বাতাস যখন নদীর মতো বয়
রাতের কানে আঁধার কথা কয়
খুকুর বুকে জমতে থাকে ভয়
তখন আমার ইচ্ছে জাগে
একটু পেলে ছুটি
ওই আকাশে তারার মতো ফুটি।

সাত-সকালে শিশির যখন ঝরে
নরম ছোঁয়ায় ফুলের ওপর পড়ে
সূর্যমুখী পাপড়ি মেলে ধরে
সেই সুবাসে যায় না থাকা ঘরে
তখন আমার ইচ্ছে জাগে
একটু পেলে ছুটি
ওই বাগানে ফুলের মতো ফুটি।

একটি নীরব শান্ত দুপুর বেলা
গাছের শাখায় হাজার পাখির মেলা
নীল আকাশে ধবল মেঘের ভেলা
চোখের পলক যায় না যখন ফেলা
তখন আমার ইচ্ছে জাগে
একটু পেলে ছুটি
ওই আকাশে পাখির মতো জুটি।

নিকেল করা একটি বিকেল এলে
সূর্য পালায় রোদের ডানা মেলে
ছুটে বেড়ায় একটি অবুঝ ছেলে
নরম পায়ে আলতো কদম ফেলে
তখন আমার ইচ্ছে জাগে
একটু পেলে ছুটি
সবার ঠোঁটে হাসির মতো ফুটি।
...

মিথ্যে কথা / শঙ্খ ঘোষ

...

লোকে আমায় ভালোই বলে দিব্যি চলনসই
দোষের মধ্যে একটু নাকি মিথ্যে কথা কই।
ঘাটশিলাতে যাবার পথে ট্রেন-ছুটছে যখন
মায়ের কাছে বাবার কাছে করছি বকম বকম।
হঠাৎ দেখি মাঠের মধ্যে চলন্ত সব গাছে
এক একরকম ভঙ্গি ফোটে এক একরকম নাচে।
“ওমা , দেখো নৃত্যনাট্য” -যেই বলেছি আমি
মা বকে দেয় , “বড্ড তোমার বেড়েছে ফাজলামি।”
চিড়িয়াখানার নাম জানো তো আমার সেজ মেসোর
আদর করে দেখিয়ে দিলেন পশুরাজের কেশর।
ক’দিন পরে চুন খসানো দেয়াল জুড়ে এ কী
ঠিক অবিকল সেইরকমই মূর্তি যেন দেখি ?
ক্লাসের মধ্যে যেই বলেছি সুরঞ্জনার কাছে
“জানিস ? আমার ঘরের মধ্যে সিংহ বাঁধা আছে !”
শুনতে পেয়ে দিদিমণি অমনি বলেন “শোন ,
এসব কথা আবার যেন না শুনি কখনো।”
বলি না তাই সে সব কথা সামলে থাকি খুব
কিন্তু সেদিন হয়েছে কি এমনি বেয়াকুব-
আকাশপারে আবার ও চোখ গিয়েছে আটকে
শরৎ মেঘে দেখতে পেলাম রবীন্দ্রনাথকে।
...

খুকুর ভাবনা / শিবরাম চক্রবর্তী

...

    আলজিভেরই অপারেশন কালকে হবে খুকুর।
    খুকু যাবে হাসপাতালে। আজকে সারা দুপুর
    বোঝায় তাকে মা যে, “মোটেই একটুও ভয় নেই !
    লাগে নাকো কোথাও কিছু। দেখতে না দেখতেই
    হয়ে যায় সে অপারেশন। যায় না পাওয়া টের।
    তারপরেই না বাড়ি ফিরে আমোদ করো ফের।
    সেই যে যেমন অপারেশন সেবার হলো আমার ?
    হাসপাতালে দুদিন থেকেই এলাম ফিরে আবার
            কেমন মজা করে’?
    তুমিও তেমনি আসবে বাড়ি মোটরগাড়ি চড়ে।”

            বল্ল খুকু, মিনিটখানেক থামি,
    “হাসপাতালে যেতে মোটেই ভয় পাইনে আমি।
    তোমার মতন অপারেশন হোক্ না কেন আমার!
    ভয় কি তাতে ? কিন্তু একটা কথা জেনো আমার-
    হাসপাতালের লোকেদের মা কিরকম যে বেভার !
    খেল্না দেবার নামে তোমায় গছিয়ে দিল সেবার
            কাঁদুনে এক খোকা !
    আমি কিন্তু নেব না তা। নইকো অতো বোকা।
    বলে দিয়ো খোকা দিতে আছে খুকুর মানা।
            খুকুর আমার চাই যে কুকুর ছানা।”
...

বীজের আকাশ / রণদীপম বসু

...

বীজটা হঠাৎ খুললো কপাট বনের নিরালায়
দেখি,- ভেতরে এক বৃক্ষ-শিশু
সবুজ সবুজ চোখ মেলে তার পিটপিটিয়ে চায়।
আমায় দেখে বললো ডেকে-
        ‘কী গো খোকা খুঁজছো কিছু?
বলতে পারো আমার কাছে খোলে নির্দ্বিধায়।’

গাছ কি কথা বলতে পারে?
মনে মনে খটকা বাড়ে,
তবু তাকে কেমনে বলি-
হারিয়ে যাওয়া সেই পাখিটা
ছোট্ট আমার ইচ্ছে পাখি
আধেক কথা বললে যাকে
        বলে দিতো আর বাকীটা।
যখন-তখন ঝুট-ঝামেলা
বাঁধাতো যে সারাবেলা,
খোলা আকাশ টানলো তাকে- টানলো সবুজ বন?
বুকের খাঁচা রইলো খোলা, নেই সেখানে মন!

আমার কথা বুঝলো কি না
ঠিক জানি না,
বললো সে ফের- ‘এসো আমার কাছে,
তোমার পাখি যায়নি কোথাও এই এখানেই আছে।
ওই দেখোনা সবুজ আকাশ
        লাল তারা আর নীল মেঘেদের ভীড়ে
আরো কতো ইচ্ছে পাখি উড়ছে ঘুরে-ফিরে।’
অবাক ভারি,- বীজের ভেতর আকাশ থাকে!
চাঁদ- সূর্য তারাও থাকে?
হি-হি হেসে বললো সে ওই-
‘তুমিও তো বীজের মতোই,
সব বীজেরই বুকের ভেতর সেই সে আকাশ থাকে
ইচ্ছেগুলো আকাশটাতেই রঙ ভরিয়ে রাখে।
ভয় কিছু নেই-
আমার আকাশ দেখতে কি চাও?
        চোখ মেলো ওই মন-জানালায়।’
তার কথাতে উঁকি দিতেই-
কোত্থেকে এক সবুজ চাদর জড়িয়ে গেলো গায়!

অমনি হঠাৎ চমকে দেখি- কী ভয়ানক,
                কোথায় আমার গা!
আগা-গোড়াই বৃক্ষ-চারা, শেকড় আমার পা!
হাত দুটোও ডাল হয়ে সব পাতার বোঁটায় বাঁধা,
সবুজ পাতার অবুঝ চোখে লাগলো বুঝি ধাঁ-ধা!
তাহলে কি গাছই হলাম, সটান সোজা গাছ?
দৌঁড়বো না আর খেলবো না আর-
ছুটবো না কি পুকুর ঘাটে, ধরবো না আর মাছ?
ঘাটের পাশের কেওড়া ঝোপে পেতে দিয়ে কান-
চুপি-চুপি শুনবো না আর ঝিঁ-ঝিঁ পোকার গান?

    মজা আলোয় সন্ধ্যা নামে গুমড়ে ওঠে বুক-
থেকে থেকে ওঠছে ভেসে মায়ের আকুল মুখ।
কী করে যে মা-কে জানাই
তাঁর খোকা আর সেই খোকা নাই
কেমনে যাবে মায়ের কাছে-
মাটির শেকল গাছ-শরীরে বাঁধা,
    মুখটাও কি তেমনি আছে!
            যাবে কি আর আগের মতো কাঁদা?
   
    হঠাৎ শুনি-
    ‘কী রে পাজি, ডাকছি এ-তো!
    চল্ চল্ চল্ খেতে যাবি’- মা এগিয়ে আসে,
    ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো বুঝি ;
    জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখি-
    দুষ্টু-মুখু গাছগুলো সব খিলখিলিয়ে হাসে!
...

অন্য মা / রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

...
    আমার মা না হয়ে তুমি
            আর কারো মা হলে
    ভাবছ তোমায় চিনতেম না,
            যেতেম না ওই কোলে ?
    মজা আরো হত ভারি,
    দুই জায়গায় থাকত বাড়ি,
    আমি থাকতেম এই গাঁয়েতে,
            তুমি পারের গাঁয়ে।
    এইখানেতেই দিনের বেলা
    যা-কিছু সব হত খেলা
    দিন ফুরোলেই তোমার কাছে
            পেরিয়ে যেতেম নায়ে।
    হঠাৎ এসে পিছন দিকে
    আমি বলতেম, “বল্ দেখি কে ?”
    তুমি ভাবতে, চেনার মতো,
            চিনি নে তো তবু।
    তখন কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে
    আমি বলতেম গলা ধরে-
    “আমায় তোমায় চিনতে হবেই,
            আমি তোমার অবু!”

কাজের ছেলে / যোগীন্দ্রনাথ সরকার

...

    ‘দাদ্খানি চাল্, মুসুরির ডাল, চিনি-পাতা দৈ,
    দু’টা পাকা বেল, সরিষার তেল, ডিম-ভরা কৈ।
    পথে হেঁটে চলি, মনে মনে বলি, পাছে হয় ভুল ;
    ভুল যদি হয়, মা তবে নিশ্চয়, ছিঁড়ে দেবে চুল।

    ‘দাদ্খানি চাল, মুসুরির ডাল, চিনি-পাতা দৈ,
    দু’টা পাকা বেল, সরিষার তেল, ডিম-ভরা কৈ।’

    বাহবা বাহবা- ভোলা ভুতো হাবা খেলিছে তো বেশ !
    দেখিব খেলাতে, কে হারে কে জেতে, কেনা হলে শেষ।
    ‘দাদ্খানি চাল, মুসুরির ডাল, চিনি-পাতা দৈ,
    ডিম-ভরা বেল, দু’টা পাকা তেল, সরিষার কৈ।’

    ওই তো ওখানে ঘুড়ি ধরে টানে, ঘোষেদের ননী ;
    আমি যদি পাই, তা হলে উড়াই আকাশে এখনি !
    দাদ্খানি তেল, ডিম-ভরা বেল, দুটা পাকা দৈ,
    সরিষার চাল, চিনি-পাতা ডাল, মুসুরির কৈ !

    এসেছি দোকানে- কিনি এই খানে, যত কিছু পাই ;
    মা যাহা বলেছে, ঠিক মনে আছে, তাতে ভুল নাই !
    দাদ্খানি বেল, মুসুরির তেল, সরিষার কৈ,
    চিনি-পাতা চাল, দু’টা পাকা ডাল, ডিম-ভরা দৈ।
...

লিখছি আমি / মৃদুল দাশগুপ্ত

...

নাম বলেছি , ধাম বলেছি- এবং বয়স কত
সেই সঙ্গে এও বলেছি মা হয়েছেন গত।
দশখানা আঁক কষতে দিলে একটা হবে ভুল
আমাকে তাও নিতে নারাজ এই তোমাদের স্কুল !

কারণ আমার প্যান্টে ফুটো জামার কলার ফাঁসা
উড়াল সেতুর নীচে আমার পাখ-পাখালির বাসা।
বাবা উধাও পুলিশভ্যানে তখন আমি ছোটো ,
মরার আগে মা বলেছেন মানুষ হয়ে ওঠো।

সেই কারণেই বই পড়েছি , পথ কুড়োনো বই
তোমার সঙ্গে আজকে না হোক , কালকে তো খেলবোই।
...

ঝড় / মৈত্রেয়ী দেবী

...

ওমা, সেদিন হাটের ধারে, মাঠের ধারে-
করতে গেছি খেলা
-দুপুরবেলা,
এমন সময়, এলোমেলো
কোথা থেকে বাতাস এলো!
হঠাৎ থেকে থেকে
অন্ধকারে সমস্ত দিক কেমন ছিল ঢেকে।
বল্লে ওরা, ছুটে পালাই ঘর
    ওই এসেছে ঝড়।

আমার যেন লাগলো ভারী ভালো-
চেয়ে দেখি আকাশখানা এক্কেবারে কালো।
কালো হ’ল বকুলতলা,
    কালো চাঁপার বন,
    কালো জলে দিয়ে পাড়ি
    আসলো মাঝি তাড়াতাড়ি,
    কেমন জানি করল আমার মন।

-ঝড় কারে মা কয়?
আমার মনে হয়,-
    কাদের যেন ছেলে,
কালির দোয়াত কেমন করে’ হঠাৎ দিল ফেলে,
যেমন করে’ কালি-
আমি তোমার মেঝের উপর ঢালি।
হাসল কোমল ঠোঁটটি মেলে
ভীষণ কেমন আগুন জ্বেলে
আকাশ বারে বারে,
আবার বুঝি ঘুরে ঘুরে
পালিয়ে গেল অনেক দূরে
সাত সাগরের পারে।
...

বর্ষাকালের চিঠি / মনোরঞ্জন পুরকাইত

...

লিখছি চিঠি বর্ষাকালের
        কালকে দেব ডাকে
সঙ্গে যাবে মেঘের সারি
        পেরিয়ে সবুজটাকে।
থামবে চিঠি উঠোন মাঝে
        বন্ধু যেথায় থাকে
টাপুর টুপুর বৃষ্টি ঝরে
        গাছ-গাছালির ফাঁকে।

লিখছি তাকে কাটছে কেমন
        বর্ষাকালের বেলা
দেখছো বুঝি বনময়ূরীর
        খুশির পেখম মেলা।
কাটছে জানি বৃষ্টি দেখে
        পাতায় পাতায় মাঠে
অঙ্ক ভূগোল ইংরাজীতে
        আমার সময় কাটে।
ইচ্ছে হলেও ভিজতে মানা
        মায়ের খিটিমিটি
তাইতো লিখি বন্ধুকে আজ
        বর্ষাকালের চিঠি।
...

বাংলাদেশ / মুক্তিহরণ সরকার

...

একটা যদি ছবি আঁকি এমন
    যেমন-    ছোট্ট নদী গাঁয়ের কোলে মেশে
            নৌকোগুলো যাচ্ছে কোথাও ভেসে
            গাঙচিলেরা পড়ছে যেন ঝুঁকে
            ও-পারেতে বন-বনানীর বুকে
    যেন,        এমনিতরো স্নিগ্ধ পরিবেশ
        তোমরা তখন বলবে জানি এ-তো বাংলাদেশ।

        একটা যদি ছবি আঁকি এমন
যেমন-     চারদিকে শষ্য-শ্যামল মাঠ,
        মাঠের পাশে নদীর খেয়াঘাট।
                আকাশ পারে যায় ভেসে মেঘ রাশি
        বটের ছায়ায় রাখাল বাজায় বাঁশি।
যেন-        শেষ হয়নি তার সে গানের রেশ;
        তোমরা তখন বলবে জানি এ-তো বাংলাদেশ।

        একটা যদি ছবি আঁকি এমন
যেমন-     কলসী কাঁখে মেয়েরা যায় ঘাটে,
        সূর্যটা ওই যাচ্ছে ডুবে পাটে,
        সেই ছবিতে হয়তো আরো আঁকি
        দিনের শেষে ফিরছে ঘরে পাখি,
যেন-        বেলা শেষের গান হয়নি শেষ;
        তোমরা তখন বলবে জানি এ-তো বাংলাদেশ।
...

যখন বড় হবো / মিহির মুসাকী

...

আমায় তুমি সকাল বিকেল মাগো
মন দিয়ে বই পড়তে শুধু বলো,
দাও বকুনি সন্ধ্যে হতেই কেন-
ঘুমে আমার দু’চোখ টলোমলো।

সব কিছুতে তোমার কেবল তাড়া
সাত-সকালে উঠতে হবে জেগে,
সময় মতো ইশকুলে না গেলে
চোখ রাঙিয়ে বলবে কথা রেগে।

বিকেল হলে ছুটবো যখন মাঠে
বলবে তুমি-ফিরবি তাড়াতাড়ি,
ভাববে নাতো বন্ধ রেখেই খেলা
কেমন করে ফিরবো আমি বাড়ি?

কথায়-কাজে দাও উপদেশ কতো
চলতে বলো সাবধানে পথ-ঘাটে,
আমার মতন এমন ভালো ছেলে
চাও যেন আর হয় নাকো তল্লাটে।

চোখ বুঁজে তাই তোমার কথা মেনে
বড় হবার জন্য শুধু পড়ি,
তুমি খুশি হলেও কিন্তু মনে-
দাগ কেটে দাও ভাবনার চকখড়ি।

কারণ-আমি হই যদি খুব বড়
থাকবে কে মা তোমার এ-বুক জুড়ে?
বইগুলো সব হাওয়াই জাহাজ হয়ে
ভাসিয়ে নেবে আমায় অনেক দূরে।

এখন যেমন পাচ্ছো আমায় কাছে
ইচ্ছে হলেই করছো আদর ডেকে,
জ্ঞানের সাগর হলে কি আর তখন
আঁচল দিয়ে পারবে রাখতে ঢেকে?

এখন আছি তোমার একার মাগো
কিন্তু যখন সবার হবো আমি,
হয়তো ভীষণ অবাক হবে দেখে
তোমার ছেলে কত্তো নামি-দামি!

বলো এবার তেমন বড় হলে
পারবে তুমি আমাকে আর ছুঁতে?
আমিও কি আর পারবো তখন মাগো
তোমার কোলে আরাম করে শুতে!
...

স্বপ্ন রাখাল / রণদীপম বসু

...

টুপ করে যেই ঘুম কেটে যায়
ভেসে কি ওঠে ছেলেবেলা ?
আমি তো নই, সেই খোকাটি
দাবড়ে বেড়ায় সারাবেলা
নদীর বুকে।

বউ টুনটুন পাখির ছানার
কান্না কি আর বাজে বুকে
মনটা যে তার মগডালেতে
ভাঙছে বাদাড় মনের সুখে
গন্ধ শুঁকে।

স্বপ্ন-রাখাল যায় উড়িয়ে সন্ধ্যারাঙা ধুলোর ঢেউ
আকাশ গাঙের খেয়ায় চড়ে রঙ ছড়িয়ে যায় যে কেউ
বাড়ির পাশের জামির গাছে কাচের চুঁড়ি বাঁধলো কে
দূর অজানায় বাজলে বাঁশি মন উড়ে যায় কোন লোকে।

স্বপ্নলোকের কল্পপুরে
ডুব দিয়ে ফের ভাসলো কে
রঙ মুখে!
আমি তো নই, সেই খোকাটি
মায়ের কোলে ঘুমায় য।
...
(০৫/১০/২০০৬)

রূপকথা / মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান

...

এক যে ছিল রাজকুমারী অচেনা এক দেশে
শুনবে যদি গল্পটি তার বসো কাছে এসে।

সাত-সাগরের পরপারে ধু-ধু বিজন চরে
রাজকুমারী বন্দী এখন দৈত্যপুরীর ঘরে।
রাজার মেয়ে সাগরপারে ঝিনুকে মুখ দ্যাখে
চুল জড়িয়ে ঝিনুক আবার ভাসায় একে একে
হায়রে ফুলের বাহার কোথায় এলো কাজল কেশে।

হাজার হাজার রাজার ছেলে ঝিনুক পেয়ে তীরে
ছুটে এলো দানোর দেশে আর গেল না ফিরে।
এমন সময় আর এক কুমার ঝিনুক পেল হাতে,
রাজকুমারীর বিপদ কথা জানলো সাথে সাথে-
পাল তুলে তার জাহাজ নিয়ে চললো সেথায় ভেসে।

কন্যা বলে, পালাও কুমার দৈত্য এলো বলে
কুমার বলে, দৈত্য দেখি বাঁচে কিসের ছলে;
ডুব দিয়ে সে পাতাল খুঁজে ভোমরা মারে যে-ই,
আকাশ ভেঙে দৈত্য এলো, মরলো পলকেই-
রাজকুমারীর মুখে হাসি ফুটলো আবার শেষে।
...

শাসন / মুরারিমোহন সেন

...

    মা রেগে কন্ , “মিনুরে আজ শাসন করা চাই,
                দুষ্টু অমন কোথাও আর নাই !
    লেখাপড়া কাজের বালাই কিছু তো নেই তার,
                ওকে নিয়ে থাকাই হোল ভার।
                সইব না আর আমি,
    তোমার আদর পেয়েই যে ওর বেড়েছে নষ্টামি।
                আদুরে অই লক্ষীছাড়াটির
     গুণের চোটে পাড়ার লোকে হয়েছে অস্থির !
    দিনে দিনেই হচ্ছে কেমনতরো,
                আজকে তুমি শাসন তারে করো !”
    বাপ শুনে কন্ হেসে-
    “জানি আমি জানি দুষ্ট যে সে !
                আচ্ছা তুমি চুপটি কোরে থাকো
                    ভাবনা কোরো নাকো !”
    এই বলে বাপ ডাকেন জোরে, “কোথায় মিনু মাগো
                একটু আমার সামনে এসো নাগো,”-
                তখন মিনুরাণী,
    খেলছে বসে সবার সাথে রান্নাঘরে পুতুল-টুতুল আনি’।
                বাবার গলা শুনলো যখন, দৌড়ে ছুটে এসে
                দাঁড়ালো তাঁর কোলের কাছে ঘেঁসে।
    বাপের কাছে মেয়ে
    দাঁড়িয়ে থাকে সকৌতুকে মুখের পানে চেয়ে।
    বাপ মেয়েকে আদর কোরে জড়িয়ে ধ’রে বুকে
                চুমু খেলেন মুখে,-
                তার পরেতে হেসে বলেন “শোনো
    -মিনু মাগো, দুষ্টুমি আর কোরোনা কক্ষনো।”-
                মিষ্টি হেসে ঘাড় নুইয়ে তার
    ব’ল্লে মেয়ে- “আচ্ছা আমি কোরবো নাকো আর !”
                এই কথাটি বোলে
    মিনু আবার লাফিয়ে গেল চ’লে-
                যেখানে তার খেলার সাথি সব
                    ক’রছে কলরব।
    অবাক হোয়ে দেখেন মাতা শাসন করার ধাত্-
                হতাশ হোয়ে কপালে দেন হাত !
...

নদী-স্বপ্ন / বুদ্ধদেব বসু

...

কোথায় চলেছো ? এদিকে এসো না! দুটো কথা শোনো দিকি,
এই নাও-এই চক্চকে, ছোটো, নতুন রূপোর সিকি।
ছোকানুর কাছে দুটো আনি আছে , তোমারে দেবো গো তা-ও,
আমাদের যদি তোমার সঙ্গে নৌকায় তুলে’ নাও।
নৌকা তোমার ঘাটে বাঁধা আছে-যাবে কি অনেক দূরে ?
পায়ে পড়ি, মাঝি, সাথে নিয়ে চলো মোরে আর ছোকানুরে।
আমারে চেনো না ? মোর নাম খোকা, ছোকানু আমার বোন।
তোমার সঙ্গে বেড়াবো আমরা মেঘনা-পদ্মা-শোন্।
দিদি মোরে ডাকে গোবিন্দচাঁদ, মা ডাকে চাঁদের আলো,
মাথা খাও, মাঝি, কথা রাখো! তুমি লক্ষী, মিষ্টি, ভালো!
বাবা বলেছেন, বড় হ’য়ে আমি হব বাঙলার লাট,
তখন তোমাকে দিয়ে দেবো মোর ছেলেবেলাকার খাট।
চুপি-চুপি বলি, ঘুমিয়ে আছে মা, দিদি গেছে ইস্কুলে,
এই ফাঁকে মোরে-আর ছোকানুরে-নৌকায় লও তুলে।

কোনো ভয় নেই- বাবার বকুনি তোমাকে হবে না খেতে
যত দোষ সব, আমার-না, আমি একা ল’ব মাথা পেতে।
নৌকা তোমার ডুবে যাবে নাকো, মোরা বেশি ভারি নই,
কিচ্ছু জিনিস নেবো না সঙ্গে কেবল ঝন্টু বই।
চমকালে কেন! ঝন্টু পুতুল, ঝন্টু মানুষ নয়,
একা ফেলে গেলে, ছোকানুরে ভেবে কাঁদিবে ও নিশ্চয়।
অনেক রঙের পাল আছে, মাঝি ? বাদামী ? সোনালী ? লাল ?
সবুজও ? তা হলে সেটা দাও আজ, সোনালীটা দিয়ো কাল।
সবগুলো নদী দেখাবে কিন্তু। আগে চলো পদ্মায়,
দুপুরের রোদে রূপো ঝল্মল সাদা জল উছলায়।
শুয়ে’ শুয়ে’-মোরা দেখিব আকাশ- আকাশ ম-স্ত বড়,
পৃথিবীর যত নীল রঙ-সব সেখানে করেছে জড়ো !
মায়ের পূজোর ঘরটির মত, একটু ময়লা নাই,
আকাশেরে কে যে ধোয় বারবার, তুমি কি জানো তা ভাই ?
কালো কালো পাখী বাঁকা ঝাঁক বেঁধে উড়ে চলে যায় দূরে,
উঁচু থেকে ওরা দেখিতে কি পায় মোরে আর ছোকানুরে ?
রূপোর নদীতে রূপোর ইলিশ- চোখ ঝল্সানো আঁশ,
ওখানে দ্যাখো না- জালে বেঁধে জেলে তুলিয়াছে একরাশ।
ওটা চর বুঝি ? একটু রাখো না, এ তো ভারি সুন্দর !
এ যেন নতুন কার্পেট বোনা ! এই পদ্মার চর ?

ছোকানু, চল রে চান ক’রে আসি দিয়ে সাত-শোটা ডুব,
ঝাঁপায়ে-দাপায়ে টলটলে জলে নাইতে ফূর্তি খুব।
ইলিশ কিনলে ? -আঃ, বেশ বেশ, তুমি খুব ভালো, মাঝি।
উনুন ধরাও, ছোকানু দেখাক রান্নার কারসাজি।
খাওয়া হ’লো শেষ, আবার চলেছি, দুলছে ছোট্ট নাও,
হালকা নরম হাওয়ায় তোমার লাল পাল তুলে দাও।
আমরা দু’জন দেখি ব’সে-ব’সে আকাশ কত না নীল,
ছোটো পাখি আরো ছোটো হ’য়ে যায়- আকাশের মুখে তিল।
সারাদিন গেলো, সূর্য লুকোলো জলের তলার ঘরে,
সোনা হ’য়ে জ্ব’লে পদ্মার জল কালো হ’লো তার পরে।
সন্ধ্যার বুকে তারা ফুটে ওঠে- এবার নামাও পাল,
গান ধরো, মাঝি ; জলের শব্দ ঝুপঝুপ দেবে তাল।
ছোকানুর চোখ ঘুমে ঢুলে আসে- আমি ঠিক জেগে আছি,
গান গাওয়া হ’লে আমায় অনেক গল্প বলবে, মাঝি ?
শুনতে-শুনতে আমিও ঘুমোই বিছানা বালিশ বিনা-
মাঝি, তুমি দেখো ছোকানুরে, ভাই, ও বড়োই ভিতু কিনা।
আমার জন্যে কিচ্ছু ভেবো না, আমি তো বড়োই প্রায়,
ঝড় এলে ডেকো আমারে- ছোকানু যেন সুখে ঘুম যায়।
...

পাখির সঙ্গে / বিশ্বজিৎ চৌধুরী

...

গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ছিলাম , কাজ ছিল না কোনো
হলদেটে এক পাখি আমায় ডাক দিল এই শোনো।
ভয়ে আমার বুকের ভেতর ধড়াস করে ওঠে
মানুষ যেমন কথা বলে , পাখির মুখেও ফুটে !
আবার আমায় চমকে দিয়ে কইলো কথা পাখি
তুমিও যেমন একলা থাকো আমিও তেমন থাকি।
অবাক হলাম হলদে পাখি সব কথা সে জানেই
মিষ্টি করে বললো আমায় তোমার বুঝি মা নেই ?

মার কথাতে আমার হঠাৎ ঝাপসা হলো দিষ্টি
বলি , তুমি কে গো এমন কইছো কথা মিষ্টি ?
বললো পাখি , আমিই জানি দুঃখ তোমার কি
তোমার মতন ছোট্ট বেলায় মা হারিয়েছি।
তোমার মতো মা নেই যাদের হারিয়ে গেছে দূরে
তাদের আমি আপন করি মিষ্টি গানের সুরে।
...

ছুটি / বীথি চট্টোপাধ্যায়

...

পড়তে বসে যাদের এখন পড়ায় নেই মন
তাদের ডেকে বললাম, আয় ছুটির গল্প শোন।
ছুটির ডাকে পড়ায় ফাঁকি ছুটির জন্য আজ
ঝগড়াঝাটির পরেও যেন ভুলতে পারি কাজ।
ছুটির ডাকে ঘুম ভেঙেছে ভোরের প্রথম রেখা
ছুটির কথা বাংলাভাষায় মুগ্ধ চিঠি লেখা;
ছুটির স্বপ্ন পড়ার বইয়ে লুকিয়ে রাখা বই
বই-এর পাতায় চোখের পাতা চোখের পাতায় বই।

হঠাৎ আমায় থামিয়ে দিল কিশোর ছেলেটি,
অবাক চোখে প্রশ্ন করে ছুটির মানে কী!
...

রোদ বালিকা / রণদীপম বসু

...

আলোর দুপুর উল্টে দিয়ে
আগুন জামা গায়
বোশেখ এলেই রোদ বালিকার দুষ্টু নাচন
তপ্ত নূপুর পায়।

ও বালিকা দুষ্টু কেন,
এই আমাকে তুমি চেন ?
মেঘ ভাইয়ারা আরো ভালো
             তোমার মতো নয়
তবুও ভালোবাসি তোমায়-
             আর কে এমন হয়!

আমি যখন চুপটি করে
খেলতে চলি ভরদুপুরে
তুমিও না হয় অমনি আমার
             খেলার সঙ্গী হয়ো
শুধু, ওই জামাটা পাল্টে তোমার
             অন্য জামা নিও।

তখন মা আর বকবে না
যেতে বারণ করবে না
কত্তো খেলা শিখিয়ে দেবো
            খেলবে গিয়ে ঘরে,
মেঘ ভাইয়াকেও সঙ্গে এনো
            খেলার সাথি করে।
...
(২১/০৩/২০০৭)

ছবির খাতা / ফারুক হোসেন

...

ঋতু যেন একটি ছবির খাতা
এই খাতাতে ছয়টি আছে পাতা।

এক-এর পাতায় শুকনো নদী আঁকা
মাঠ-ঘাট সব শূন্য করে খাঁ খাঁ।
গাছগাছালি নিঝুম নিরিবিলি
উদোম গায়ে দাঁড়িয়ে মিলিঝিলি।

দু’-এর পাতায় আকাশ আঁকা মেঘে
ভরা নদী বইছে স্রোতের বেগে।
পথে-ঘাটে থিকি থিকি কাদা
নদীরঘাটে নৌকো ক’খান বাঁধা।

তিন-এর পাতায় কাশ শিউলি ফোটা
পড়ছে ঝরে নরোম তাদের বোঁটা।
প্রজাপতি মৌমাছি যায় উড়ে
নদীর দু’কুল শুকনো দেখায় দূরে।

চার-এর পাতায় আঁকা সোনার ধান
তুলতে সে ধান মন করে আনচান।
ধানের বোঝা মাথায় নিয়ে বাড়ি-
আসছে হেঁটে কিষাণ সারি সারি।

পাঁচ-এর পাতায় গাছগাছালি আঁকা
পাতা ঝরে ডালপালা সব ফাঁকা।
ভোরের হাওয়ায় ঠোঁট দু’টো থির কাঁপে
দাঁড়িয়ে খোকন ওম নেবে রোদ-তাপে।

ছ’-এর পাতা নানান ফুলে বোনা
বনে নতুন পাখির আনাগোনা
লাটাই হাতে কয়টি ছেলে মাঠে,
বাতাস বনের মাথায় বিলি কাটে।

ছবির খাতা যেই না দেখা শেষ
ভাসলো চোখে আমার বাংলাদেশ।
...

মন ভালো নেই / ফারুক নওয়াজ

...

যখন পাখি বেঢপ সুরে ডাকিস
পাখিরে তোর মন ভালো নেই বুঝি
বৃ যখন ঝিম মেরে তুই থাকিস
বুঝতে পারি মন ভালো নেই তোরও।

মন ভালো নেই পুষ্পরে তোর জানি
বিলাস না তুই গন্ধ আগের মতো
মন ভালো নেই, মন ভালো নেই মেঘের
মন ভালো নেই আকাশ পাড়ের চাঁদের
শুকতারাটি যখন নীরব, বধির
তখন বুঝি মন ভালো নেই তারও।

মন ভালো নেই শুকিয়ে যাওয়া নদীর
কাটা বুকের কষ্টে কাঁদে পাহাড়
মন ভালো নেই পথের, অলি-গলির
মন ভালো নেই পোকায় খাওয়া ধানের
ঝর্নাধারার ছন্দহারা গতি
মন ভালো নেই ছইঅলা নাও, ঘাটের
উড়োখুড়ো মনটা দখিন হাওয়ার
মন ভালো নেই ইস্টিশানের ট্রেনের।

কঁকিয়ে ওঠে বাজার করার থলে
মন ভালো নেই হাটখোলা, বটমূলের
যখন দেশের মন থাকে না ভালো
মন ভালো কি থাকতে পারে কারো ?
...

প্রথম সমুদ্দুর / প্রণব চৌধুরী

...

    তোমার কেন! মনে থাকার কথাও নয় কারো!
    তখন তুমি অনেক ছোট
            একটু একটু বসতে কেবল পারো।
    ঘর ছেড়ে সেই প্রথম গেলাম দূরে
    তোমায় নিয়ে এলেম সমুদ্দুরে।
অথই সাগর, ঢেউ ওঠে আর নামে
ঝড়ের মতো শো শো বাতাস
        মাথায়, ডানে-বামে,
পাহাড় ঘেঁষে উঠছে তখন
        সূর্যটা লাল বড়!
দু’ঠোঁট ভেঙে হঠাৎ কেঁদে আমায় চেপে ধরো!
কোথায় এলে অচিনপুরে! পড়লে কিসের ভিড়ে।
সামনে সাগর, পেছন আলোয় তাকাও ফিরে ফিরে।
        বিশাল বেলাভূমি,
মেঘের বুকে চাঁদের মতো
কখন বুকে
ঘুমিয়ে গেলে তুমি।
...

টুপুরের প্রার্থনা / প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়

...

আমাদের দিন কাটে সন্ধি-সমাসে
কচিৎ সিনেমা দেখি ছ-মাসে ন-মাসে।
গল্পের বইগুলো পড়ে থাকে তাকে,
ইস্কুলে এত চাপ, পড়ি কোন্ ফাকে?
ইতিহাস-ভূগোলের বিশাল তালিকা,
অঙ্কটা দিনে-দিনে পুরো বিভীষিকা।
ঘাড় গেল কুঁজো হয়ে, পিঠে এত বই-
আমাদের দিনগুলো অকূল, অথই।

এর থেকে ঢের ভালো ছোট হয়ে থাকা,
শুধু ঘুম, শুধু গান, খেলা আর আঁকা।
অথবা হঠাৎ কোনও মন্ত্রের বলে
একেবারে মিশে যাওয়া বড়দের দলে।
দুপুরে গল্প-ঘুম, সন্ধেয় টিভি,
কেমন ভাবনাহীন মজার পৃথিবী।
ওগো ঈশ্বর, ওগো অন্তরতর,
    হয় দাও ছোট করে, নয় খুব বড়।
...

স্বপ্ন / প্রমোদ বসু

...

আমি যখন পদ্য লিখি, সবার খুবই অসন্তোষ
কেউ বা বলেন পক্ক আমি, কেউ বা ধরেন মাথার দোষ!
আমি তখন স্বপ্নে দেখি শক্তি-সুনীল, শঙ্খ ঘোষ।

আমি যখন ছবি আঁকতে খাতার পাতায় টানছি লাইন,
মা বলে যান, ‘পড়তে বসো। আঁকা বন্ধ- বাবার আইন।’
হা হতোস্মি! আমার কেবল স্বপ্নে বিকাশ, গণেশ পাইন!

আমি যখন গান ধরেছি বুকের গভীর আহ্লাদে,
পড়শিগণে টিটকারি দেয়-‘নচির সঙ্গে পাল্লা দে!’
কিন্তু আমার স্বপ্নে আসেন হেমন্ত আর মান্না দে!

আমি এখন পড়ছি শুধু, পড়ছি দিনরাত্রি তাই।
বাবা ভীষণ খুশি এবং মা বলছেন, ‘বল, কী চাই?’
বলবো, ‘শুধু স্বপ্ন দেখার সময় যেন একটু পাই!’
...

আকাশের ইশকুল / রণদীপম বসু

...

জোছনা বুনে রাতটা নাকি
ফোটায় তারার ফুল
একটি রাতের তারা গুনে
সব হয়ে যায় ভুল!
একটি রাতের ফুলতারাদের
মিটিমিটি হাসি
দেখবে নাকি গুনবে তাদের-
হয় না পাশাপাশি;
গুনতে গেলে হয়না দেখা
নামতাগুলো যতই শেখা
মন হয়ে যায় পাখি,
ঘুম-তাড়ুয়া ইচ্ছেগুলো
মা’র চোখে দেয় ফাঁকি।

সবাই যখন ঘুমের পাড়ে
খোকন তখন চুপিসারে
আকাশটাকে খুলেই দেখে- একী!
রঙের মাখামাখি !
কে যেন আজ নতুন করে
করলো আঁকাআঁকি।

নতুন রাতের নতুন আকাশ
নতুন দেখার ফুল
নামতা ভুলে খোকন খোঁজে
আকাশের ইশকুল।
...
(২৮/০২/২০০৭)

বিষ্টি / নির্মলেন্দু গুণ

...

আকাশ জুড়ে মেঘের খেলা
বাতাস জুড়ে বিষ্টি,
গাছের পাতা কাঁপছে আহা
দেখতে কী যে মিষ্টি!

কলাপাতায় বিষ্টি বাজে
ঝুমুর নাচে নর্তকী,
বিষ্টি ছাড়া গাছের পাতা
এমন করে নড়তো কি?

চিলেকোঠায় ভেজা শালিখ
আপন মনে সাজ করে,
চঞ্চু দিয়ে গায়ের ভেজা
পালকগুলি ভাঁজ করে।

হাঁসেরা সব সদলবলে
উদাস করা দিষ্টিতে
উঠানটাকে পুকুর ভেবে
সাঁতার কাটে বিষ্টিতে।

আকাশ এতো কাঁদছে কেন
কেউ কি তাকে গাল দিলো?
ছিঁচকাঁদুনে মেঘের সাথে
গাছগুলি কি তাল দিলো?

সকাল গেল, দুপুর গেল-
বিকেল হ’য়ে এলো কী?
আচ্ছা মাগো তুমিই বলো
মেঘেরা আজ পেলো কী?
...

রুমির ইচ্ছা / নরেশ গুহ

...

আমি যদি হই ফুল,        হই ঝুঁটি-বুলবুল   হাঁস
        মৌমাছি হই একরাশ,
তবে আমি উড়ে যাই,        বাড়ি ছেড়ে দূরে যাই,
ছেড়ে যাই ধারাপাত,        দুপুরের ভূগোলের  ক্লাস।
তবে আমি টুপটুপ,            নীল-হ্রদে দিই ডুব  রোজ
        পায় না আমার কেউ খোঁজ।
তবে আমি উড়ে-উড়ে        ফুলেদের পাড়া ঘুরে
        মধু এনে দিই এক ভোজ।
হোক আমার এলো চুল,        তবু আমি হই ফুল   লাল
        ভরে দিই ডালিমের ডাল।
ঘড়িতে দুপুর বাজে;        বাবা ডুবে যান কাজে;
        তবু আর ফুরোয় না আমার সকাল।
...

বৃষ্টি যদি দৃষ্টি পেতো / জুলফিকার শাহাদাৎ

...

বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি পড়ে
মেঘলা মেয়ের একলা দু’চোখ
উপুড় করে
বৃষ্টি পড়ে।
বৃষ্টি পড়ে
শব্দ করে
শব্দ কিসের?
শব্দ তো নয়
দুঃখ ব্যথা
কান্না হাসির
লিরিক ঝরে
বৃষ্টি পড়ে।

বৃষ্টি এসে-
ভাসায় নদী, ভাসায় বাড়ি
ভাসিয়ে নেয় মায়ের শাড়ি
ভাসিয়ে নেয় সুখ আহ্লাদ
খড়কুটো ও দালান প্রাসাদ
ভাসায় ফসল, ভাসায় পাহাড়
যায় ভেসে যায় মুখের আহার।

বৃষ্টি কেমন দৃষ্টিহারা
মাটির কোলে মানুষ মরে
লাশের পাহাড় থরে থরে
পাখির ডাকে পশুর ডাকে
রক্তজবা নদী আঁকে।

বৃষ্টি যদি এমন হতো-
ভাসিয়ে নিত পাপ অনাচার
মজুতদারের সবকটা ঘাড়
ভাসিয়ে নিত দুঃখ লতা
নীল কষ্টের নীরবতা।

বৃষ্টি তেমন হলে-
এই পৃথিবী থাকতো আলোয়
আলোর কোলাহলে।
...

খুকির সম্পত্তি / জসীম উদদীন

...

শিউলি নামের খুকির সনে আলাপ আমার অনেক দিনের থেকে
হাসিখুশি মিষ্টিমিশি অনেক কথা কই যে তারে ডেকে।
সেদিন তারে কইনু, ‘খুকি- কী কী জিনিস কওতো তোমার আছে ?’
সগৌরবে বলল, অনেক-অনেক কিছু আছে তাহার কাছে ;
সাতটা ভাঙা পেন্সিল আর নীল বরণের ভাঙা দু-খান কাঁচ,
মারবেল আছে তিন-চারটে, কড়ি আছে গন্ডা ছ কি পাঁচ।
ডলি পুতুল, মিনি পুতুল, কাঠের পুতুল, মাটির পুতুল আর-
পুঁতির মালা, রঙিন ঝিনুক, আরও অনেক খেলনা আছে তার।
আছে তাহার পাতার বাঁশি, টিনের উনুন, শোলার পাখির ছা,
সাতটা আছে ঝুমঝুমি তার আর আছে তার একটি খেলার মা।
...

Thursday, November 19, 2009

এমনি কি আর স্কুল ফাঁকি দিই / গৌরাঙ্গ ভৌমিক

...

    চাঁদ থাকে খালে বিলে , পুকুরের জলে ,
    যেই বলি , মাস্টার কান দেয় মলে।
        কানমলা খেতে কারো ভালো লাগে নাকি
            এ কারণে ইস্কুল দিতে হয় ফাঁকি !

    দেখেছি দশটা চাঁদ দশটা পুকুরে
    খেলা করে , ডুব দেয় রাত্রি দুপুরে।
        কি ভালো সাঁতারু ওরা , কি ভালো ডুবুরি
            মাছে আর চাঁদে হয় খুব লুকোচুরি।

    উরুগুয়ে কাছে , নাকি সূর্যটা কাছে ?
    এ প্রশ্নের উত্তর কারো জানা আছে ?
        আমি বলি , “আমি জানি উরুগুয়ে দূরে ,
            সূর্যটা রোজই আসে ছাদের উপরে।”

    মাস্টার হাসে আর বলে , ‘তুই বোকা’ ,
    মাথায় আলতো করে মারে তিন টোকা।
        লজ্জায় অপমানে চুপ করে থাকি
            এ কারণে ইস্কুল দিতে হয় ফাঁকি।
...

খোকার জানালা / রণদীপম বসু

...

খোকার জানালা  সোনারোদ মাখা
মনভোলা এক কবি
রঙ ও রেখায়  মাখামাখি করে
প্রভাতের জলছবি।
সারি সারি গাছ  সবুজ আদর
কুয়াশা আঁচলে ঘেরা
ভোরের পাখিরা  কাকলি ছড়ায়
নেচে ওঠে বাতাসেরা।

খোকার জানালা  ধুলো মাখা পথ
ছুঁইবে নদীর কূল
শিশিরে জড়ানো  দূর্বা-ঘাসের
ফাঁকে ফাঁকে ভেজা ফুল।
ঘুঘু ডাকা মন  ক্লান্ত দুপুরে
ডাক দিয়ে যায় কারে
মুখর বিকেল  ডানপিঠে চোখে
ফিরে আসে বারে বারে।

খোকার জানালা  আলোর ফোয়ারা
ছায়া মাখা ভিটে ঘর
দেয়ালের গায়ে  লুকোচুরি খেলে
খোকনের অন্তর।
অন্তর তলে  আরো এক খোকা
পিটপিটে চোখে যেন
হরেক প্রশ্নের  জানালা খোলে-
‘এটা কেন ওটা কেন ?’

খোকার জানালা  মুক্ত আকাশ
রোদে জলে কথা কয়,
একটা জানালা  হাজারটা হয়ে
আকাশেই আঁকা রয়।
...
(২১/১২/২০০৬)

মাঠ মানে ছুট / কার্তিক ঘোষ

...

মাঠ মানে কি মজাই শুধু মাঠ মানে কি ছুটি-
মাঠ মানে কি অথৈ খুশির অগাধ লুটোপুটি !
মাঠ মানে কি হল্লা শুধুই মাঠ মানে কি হাসি-
মাঠ মানে কি ঘুম তাড়ানো মন হারানো বাঁশি !
মাঠ মানে কি নিকেল করা বিকেল আসা দিন ,
মাঠ মানে কি নাচনা পায়ের বাজনা তাধিন ধিন !
মাঠ মানে তো সবুজ প্রাণের শাশ্বত এক দীপ-
মাঠ মানে ছুট এগিয়ে যাবার-পিপির পিপির পিপ।

ছুট মানে কি ছোটাই শুধু ছুট মানে কি আশা-
ছুট মানে কি শক্ত পায়ের পোক্ত কোন ভাষা।
ছুট মানে কি সাহস শুধু ছুট মানে কি বাঁচা ,
ছুট মানে কি ছোট্ট পাখির আগল ভাঙা খাঁচা !
ছুট মানে কি ছুটন্ত আর ফুটন্ত সব প্রাণে-
সাতটি সবুজ সমুদ্দুরের ঢেউকে ডেকে আনে !
ছুট মানে তো জীবন এবং ছুট মানে যে সোনা-
ছুট মানে কি ছুটেই দেখ- আর কিছু বলবো না।
...

খুকি ও কাঠবেরালি / কাজী নজরুল ইসলাম

...

    কাঠবেরালি ! কাঠবেরালি ! পেয়ারা তুমি খাও ?
    গুড়-মুড়ি খাও ? দুধ-ভাত খাও ? বাতাবি-নেবু ? লাউ ?
        বেরাল-বাচ্চা ? কুকুর-ছানা ? তাও-
        ডাইনি তুমি হোঁৎকা পেটুক,
        খাও একা পাও যেথায় যেটুক!
        বাতাবি-নেবু সকলগুলো
        একলা খেলে ডুবিয়ে নুলো!
    তবে যে ভারি ল্যাজ উঁচিয়ে পুটুস্ পাটুস্ চাও ?
    ছোঁচা তুমি! তোমার সঙ্গে আড়ি আমার! যাও!

কত ভালবাসি / কামিনী রায়

...

    জড়ায়ে মায়ের গলা শিশু কহে আসি-
            ‘মা তোমারে কত ভালবাসি।’
    ‘কত ভালবাস ধন ?’ জননী সুধায়।
            ‘এ-তো-’ বলি দুই হাত প্রসারি দেখায়।

    ‘তুমি মা আমারে ভালবাস কত খানি ?’
    মা বলেন, ‘মাপ তার আমি নাহি জানি।’
    ‘তবু কতখানি, বল !’ ‘যতখানি ধরে
    তোমার মায়ের বুকে।’ ‘নহে তার পরে ?’
    ‘তার বাড়া ভালবাসা পারিনা বাসিতে’
    ‘আমি পারি’। বলে শিশু হাসিতে হাসিতে।
...

আমার ছবি / আমীরুল ইসলাম

...

বাঘ আঁকবো, যে বাঘ দেখে কেউ পাবে না ভয়,
আঁকবো সাগর, মানুষ যেন ঢেউয়ের সাথী হয়।

দুধেল রঙা আকাশ এঁকে ছড়িয়ে দেবে নীল,
সেই আকাশের সঙ্গে সবার থাকবে মনের মিল।

পেত্নী এঁকে রঙ ছিটিয়ে বানিয়ে দেবে পরী,
সেই পরীরা নাচবে আলোয়, শরীর ভরা জরি।

দুঃখে যাদের জীবন গড়া, দুঃখে ভরা বুক
প্রজাপতির ডানার রঙে আঁকবো তাদের মুখ।

রঙ পেন্সিল তুলির টানে আঁকবো হাজার ছবি
দুঃখ ভুলে সুখ আনবে আমার ছবি সবই।

ভাত পায় না যারা, তাদের জন্য ভাতের থালা
এঁকে তাতে ভাত ছড়াবো, মিটবে খিদের জ্বালা।

সবুজ রঙের ছোঁয়ায় ছোঁয়ায় আঁকবো এমন দেশ
যেই দেশে নেই যুদ্ধ-বিভেদ, হিংসা ও বিদ্বেষ।
...

আকাশ তুমি / আহমাদ মাযহার

...

আকাশ তুমি দূরে থাকো
হাত বাড়িয়ে ধরতে পারি নাকো
দূরেই যদি থাকলে তবে নীলের গায়ে তুমি
শাদা মেঘের স্বপ্ন কেন এমন করে আঁকো।

আকাশ তুমি এত্তো বড় কেন?
হাত বাড়িয়ে ধরতে পারি যেন
এমন ছোট হলে তোমার দোষ হতো কি বেশি?
তুমিই বলো আমার কথা খুব কি যেন তেন?

আকাশ তুমি অনেক ছোট হবে
এখন বলো কখন এবং কবে
আসবে কাছে এত্তোটুকু হয়ে আমার মতো
না হলে আর কেমন করে বন্ধু হবে তবে?

শোনো আকাশ তোমার গায়ে কারা
জ্বলে এবং নেভে? যাদের বলে সবাই তারা।
ওরা কি সব তোমার ছেলে নাকি?
তোমার ডাকে দিচ্ছে রোজই এমন করে সাড়া।

তোমার মেয়ে চাঁদকে দেখে আমি
ডাকলে কাছে বললো হেসে, ‘নামি
কেমন করে বলো এখন মায়ের কথা ছাড়া।’
তুমি আকাশ নিজকে কেন ভাবো এতোই দামী?

হতেই যদি ছোট্ট আমার মতো
তোমায় নিয়ে দূরের পাড়া যতো
ঘুরলে বলো কী মজাটাই পেতে তখন তুমি!
এখন বলো কেইবা দেবে তোমায় মজা অতো?

তবু আমার কথাগুলোর কোনো
হলো না দাম আচ্ছা তবে শোনো
বড় হয়েই ছোঁয়াবো হাত তোমার গায়ে আমি।
যতোই তুমি বড় হবার স্বপ্ন মনে বোনো।
...

আমি / আলী ইমাম

...

ঘাস ফড়িং-এর ডানা থেকে নিয়ে কিছু কাঁপন
গাছের সবুজ পাতার সাথে আমার যে দিন যাপন।
চিতল মাছের কানকো থেকে নদীর পরশ পাই
আতা ফলের শাঁসের ভেতর মিলিয়ে যেতে চাই।

বন-মুরগীর ডিমের খোলে দোলে হলুদ কুসুম
ইচ্ছে করে তার ভেতরে দেই যে নিবিড় ঘুম।
সাঁঝ আকাশের কান্ত পাখির উড়ন্ত যে ডানা
কোন পালকে কিসের আঘাত সে সব আমার জানা।

নতুন চরের পলি মাটির বুকের সতেজ ঘাস
দেয় বাড়িয়ে রোজ সকালে আমার বাঁচার শ্বাস।
হতাম যদি গভীর বনের বুনো পাখির বাসা,
খড়-কুটোতে জমিয়ে রেখে তৈরি হয়ে খাসা-

বুকের মাঝে দিতাম রেখে ছোট্ট ক’টি ডিম
যতোই নামুক আকাশ থেকে রোদ-বৃষ্টি হিম
শুকনো খড়ে ডিমগুলোকে দিতাম কিছু উম্
তুলতুলে যেই ছানা বেরোয়, তখন আমার ঘুম।
...

দূরে / আবু হাসান শাহরিয়ার

 ...

বহুদূরে মানে দূ-উ-উ-রে।
বাড়ির সীমানা,
যত কিছু জানা-
চেনা মাঠ-ঘাট,
অদূরের হাট,
বুড়ো বটমূল-
আর ইশ্কুল-
সব কিছু ছেড়ে অনেকটা পথ ঘুরে
একাই যাচ্ছি, বহুদূরে মানে দূ-উ-উ-রে।

নেই সংশয়,
বাবা-মার ভয়,
স্কুলের শাসন,
স্যারের ভাষণ,
নেই কিছু নেই
তবু তো আছেই
কত কী না-জানা অজানারা চোখ জুড়ে।
একাই যাচ্ছি বহুদূরে মানে দূ-উ-উ-রে।

দেখি নি যে ফুল,
যে নদীর কূল,
নিঝুম বাদাড়,
বুনো ঝোপ-ঝাড়,
আকাশের নীল,
তারা ঝিলমিল-
অবাক তাকিয়ে বাতাসের সুরে সুরে
একাই যাচ্ছি, বহুদূরে মানে দূ-উ-উ-রে।

আরো দূরে ধু-ধু
দিগন্ত শুধু।
আছে তারপরও
ছবি থরোথরো।
দৃশ্যের টানে
মন হার মানে-
তাইতো যাত্রা সব কিছু ছেড়ে-ছুড়ে।
একাই যাচ্ছি বহুদূরে মানে দূ-উ-উ-রে
                   দূ-উ-উ-রে
                   দূ-উ-উ-রে।
...

রূপকথা নয় / আবু হাসান শাহরিয়ার

...

সবাই ছিলো ঘুমিয়ে, আমার
দুচোখ ছিলো খোলা-
আকাশ গাঙে শুভ্র চাঁদের
নাও ছিলো পাল-তোলা।
সে-নাও হঠাৎ ভিড়লো আমার
ঘরের নিঝুম ঘাটে,
দরজা খুলে দেখি গলুই
ঠেকেছে চৌকাঠে।
লাফিয়ে চাঁদের পাটাতনে
যেই বসেছি গিয়ে
ঝড়ের বেগে ছুটলো সে-নাও
আমাকে চমকিয়ে।
আকাশ-গাঙে শ্যাওলা নরম
মেঘেরা তুলতুল
দিঘির জলে শাপলা যেমন
তেমনি তারার ফুল।
তারার সে-ফুল একটি আমি
যেই নিয়েছি ছিঁড়ে
অমনি চাঁদের নাওয়ে সটান
ঘরেই এলাম ফিরে।
ঘুম ছিলো ওত পেতেই কাছে
চোখ দু’টোকে ধ’রে
বন্দি করে রাখলো তাদের
মুক্তি দিলো ভোরে।
জেগেই হলাম তারা ফুলের
সন্ধানে উৎসুক-
দেখি আমার মুঠোয় ধরা
মায়ের হাসি মুখ।
...