Friday, May 28, 2010

জীবনসঙ্গীত / হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

...
ব'ল না কাতর স্বরে,          বৃথা জন্ম এ সংসারে
           এ জীবন নিশার স্বপন;
দারা পুত্র পরিবার             তুমি কার, কে তোমার,
           ব'লে জীব ক'রো না ক্রন্দন।
মানব জনম সার,              এমন পাবে না আর,
           বাহ্য দৃশ্যে ভুলো না রে মন।
কর যত্ন হবে জয়,              জীবাত্মা অনিত্য নয়,
           ওহে জীব কর আকিঞ্চন।
ক'রো না সুখের আশ,          প'রো না দুঃখের ফাঁস,
           জীবনের উদ্দেশ্য তা নয়,
সংসারে সংসারী সাজ          করো নিত্য নিজ কাজ
           ভবের উন্নতি যাতে হয়।

জন্মভূমি / সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী

...
হউক সে মহাজ্ঞানী মহা ধনবান,
অসীম ক্ষমতা তার অতুল সম্মান,
হউক বিভব তার সম সিন্ধু জল
হউক প্রতিভা তার অক্ষুণ্ন উজ্জ্বল
হউক তাহার বাস রম্য হর্ম্য মাঝে
থাকুক সে মণিময় মহামূল্য সাজে
হউক তাহার রূপ চন্দ্রের উপম
হউক বীরেন্দ্র সেই যেন সে রোস্তম
শত শত দাস তার সেবুক চরণ
করুক স্তাবক দল স্তব সংকীর্তন।

কিন্তু যে সাধেনি কভু জন্মভূমি হিত
স্বজাতির সেবা যেবা করেনি কিঞ্চিৎ
জানাও সে নরাধমে জানাও সত্বর,
অতীব ঘৃণিত সেই পাষণ্ড বর্বর।
...

ষোল আনাই মিছে / সুকুমার রায়

...
বিদ্যেবোঝাই বাবুমশাই চড়ি সখের বোটে
মাঝিরে কন, "বলতে পারিস সূর্যি কেন ওঠে ?
চাঁদটা কেন বাড়ে কমে ? জোয়ার কেন আসে ?"
বৃদ্ধ মাঝি অবাক হয়ে ফ্যালফেলিয়ে হাসে।
বাবু বলেন, "সারা জনম মরলিরে তুই খাটি,
জ্ঞান বিনা তোর জীবনটা যে চারি আনাই মাটি।"

খানিক বাদে কহেন বাবু "বলত দেখি ভেবে
নদীর ধারা কেমনে আসে পাহাড় হতে নেবে ?
বলত কেন লবণপোরা সাগর ভরা পানি ?"
মাঝি সে কয়, "আরে মশাই অত কি আর জানি ?"
বাবু বলেন, "এই বয়সে জানিসনেও তা কি
জীবনটা তোর নেহাৎ খেলো, অষ্ট আনাই ফাঁকি ?"

কিশোর / গোলাম মোস্তফা

...
আমরা নূতন, আমরা কুঁড়ি, নিখিল বন-নন্দনে,
ওষ্ঠে রাঙা হাসির রেখা, জীবন জাগে স্পন্দনে।
লক্ষ আশা অন্তরে
ঘুমিয়ে আছে মন্তরে
ঘুমিয়ে আছে বুকের ভাষা পাঁপড়ি-পাতার বন্ধনে।

সাগর-জলে পাল তুলে দে' কেউ বা হবো নিরুদ্দেশ,
কলম্বাসের মতই বা কেউ পৌঁছে যাবো নূতন দেশ।
জাগবে সাড়া বিশ্বময়
এই বাঙালি নিঃস্ব নয়,
জ্ঞান-গরিমা শক্তি সাহস আজও এদের হয়নি শেষ।

বনভোজন / গোলাম মোস্তফা

...
নুরু, পুশি, আয়েশা, শফি সবাই এসেছে,
আম বাগিচার তলায় যেন তারা হেসেছে।
রাঁধুনিদের শখের রাঁধার পড়ে গেছে ধুম,
বোশেখ মাসের এই দুপুরে নাইকো কারো ঘুম।
বাপ মা তাদের ঘুমিয়ে আছে এই সুবিধা পেয়ে,
বনভোজনে মিলেছে আজ দুষ্টু কটি মেয়ে।
বসে গেছে সবাই আজি বিপুল আয়োজনে,
ব্যস্ত সবাই আজকে তারা ভোজের নিমন্ত্রণে।
কেউবা বসে হলদি বাটে, কেউবা রাঁধে ভাত,
কেউবা বলে দুত্তুরি ছাই পুড়েও গেল হাত।
বিনা আগুন দিয়েই তাদের হচ্ছে যদিও রাঁধা,
তবু সবার দুই চোখেতে ধোঁয়া লেগেই কাঁদা।
কোর্মা পোলাও কেউবা রাঁধে, কেউবা চাখে নুন
অকারণে বারে বারে হেসেই বা কেউ খুন।
রান্না তাদের শেষ হল যেই, গিন্নী হল নুরু,
এক লাইনে সবাই বসে করলে খাওয়া শুরু।
ধুলোবালির কোর্মা-পোলাও আর সে কাদার পিঠে,
মিছামিছি খেয়ে সবাই, বলে--বেজায় মিঠে।
এমন সময় হঠাৎ আমি যেই পড়েছি এসে,
পালিয়ে গেল দুষ্টুরা সব খিলখিলিয়ে হেসে।
...

Thursday, May 27, 2010

যান বা হন / কৃষ্ণদয়াল বসু

...
ছুটি পেয়ে নুটুবাবু খুশি হয়ে কাশী যান,
সাথে বুড়ি শ্বাশুড়ির মেজো মা'র মাসি যান;
পাড়ার কুঁদুলে বুড়ি এলোকেশে দাসী যান;
হীরু জ্যাঠা, নীলু খুড়ো, ছিরু পাকড়াশী যান।

সাত মেয়ে সাথে এক থুথথুরি বুড়ি যান;
খোঁড়া জগু, ন্যাড়া শিবু, ট্যারা সেজো-খুড়ি যান;
কালা নুলো রাতকানা নকুল ভাদুড়ী যান;
হাবাগোবা জবুথবু মোট জনকুড়ি যান।

নুটুতো ব্যাপার দেখে রীতিমতো ক্ষেপে যান;--
যাত্রীরা সকলেই তাঁরি ঘাড়ে চেপে যান।
হাওড়ায় যেতে সবে ঠেলাগাড়ি চড়ে যান;
হুড়মুড় করে শেষে ফুটপাতে পড়ে যান।

ডাকব নাকি পুলিশ ? / শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

...
পড়ার ঘরে পড়তে বসি যখন,
বাবা ডেকে বলেন,-- 'ওরে খোকন,
মন দিয়ে খুব করিস্ লেখাপড়া--
একজামিনে নইলে খাবি বড়া।'
কিন্তু আমি পড়ি কেমন করে ?
বাবা জানেন না ত, পড়ার ঘরে
জুটেছে সব দুষ্টু পাজি যত--
পড়তে কি দ্যায় একটু মনের মত ?
বলেন বাবা-- 'কেবল পড়া ভুলিস্ !
                  ডাকব নাকি পুলিশ ?

টিকটিকি, তুই আমার দেয়ালে
ঘুরে বেড়াস্ মনের খেয়ালে।
কার হুকুমে করিস্ পোকা সাবাড় ?
পোকা ছাড়া নেই কি রে আর খাবার ?
আয় না নেমে উঁচু দেয়াল ছেড়ে,
ল্যাজটি কেটে বানিয়ে দেব বেঁড়ে!
কইলে কথা, বল্ ত ওরে নবাব,
একটি বারও দিস্ না কেন জবাব ?
পোকা-মাকড় খেয়ে কেবল ফুলিস্--
                   ডাকব নাকি পুলিশ ?

হঠাৎ যদি / প্রেমেন্দ্র মিত্র

...
আমায় যদি হঠাৎ কোনো ছলে
কেউ ক'রে দেয় আজকে রাতের রাজা,
করি গোটাকয়েক আইন জারি
দু'এক জনায় খুব কষে দিই সাজা।
মেঘগুলোকে করি হুকুম সব
ছুটি তোদের, আজকে মহোৎসব।
বৃষ্টি-ফোঁটার ফেলি চিকন চিক্
ঝুলিয়ে ঝালর ঢাকি চতুর্দিক,
দিলদরিয়া মেজাজ করে কই,
বাজগুলো সব স্ফূর্তি করে বাজা।
হাওয়ায় বলি, হল্লা করে চল
তারার বাতি নিভিয়ে দলে-দল,
অন্ধকারে সত্যি কথার শেষে
রাজকন্যা পদ্মাবতীর দেশে।
ঘুমে পুরীর সেপাইগুলো ঢোলে,
তাদের ধরে খুব কষে দেই সাজা।
আমায় যদি হঠাৎ কোনো ছলে
কেউ করে দেয় আজকে রাতের রাজা।

ইচ্ছে / প্রেমেন্দ্র মিত্র

...
এক যে ছিল তেপান্তর
            করত কেবল ধু ধু।
চাইলে একা থাকার দুঃখে
            একটি নদী শুধু।
একটি নদী ছোট্ট নদী
            কুলুকুলু বইবে,
সাধ হলে তার সাথে দুটো
            মনের কথা কইবে।
ছিল একটা ছোট্ট নদী
            সাধাসাধি করতে,
তেপান্তরে বইতে রাজি
            হল একটি শর্তে।
পাহাড় আগে চাই একটা
            হবে তারই ঝর্ণা,
নইলে কে যায় তেপান্তরে
            দিক না যতই ধরনা !
বললে পাহাড় আসুক নদী
            ঝর্ণা হয়ে ঝরতে,
তার বদলে তাজ তুষারের
            চাই যে মাথায় ধরতে।
তাই হল। সব পেল সবাই
            শাদা মুকুট পাহাড়,
ঝর্ণা থেকে হল নদী
            তেপান্তরের বাহার।
যার যা খুশি পেতেও পারে--
            শুধু চাওয়ার আগে,
ইচ্ছেগুলোয় এই দুনিয়ার
            ছন্দ যেন লাগে।
...

কুটির / অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত

...
ঝিকিমিকি দেখা যায় সোনালি নদীর,
ওইখানে আমাদের পাতার কুটির।
          এলোমেলো হাওয়া বয়,
          সারা বেলা কথা কয়,
কাশফুলে দুলে ওঠে নদীর দু'পার,
রূপসীর শাড়ি যেন তৈরি রূপার।

কুটিরের কোল ঘেঁষে একটু উঠোন,
নেচে নেচে খেলা করি ছোট দুটি বোন।
          পরনে খড়কে-ডুরে,
          বেণী নাচে ঘুরে ঘুরে,
পায়ে পায়ে- 'রুনু ঝুনু' হালকা খাড়ুর,
কেন নাচি নাই তার খেয়াল কারুর।

আসমানী / জসীম উদদীন

...
আসমানীরে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও,
রহিমদ্দির ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও।
বাড়ি তো নয় পাখির বাসা ভেন্না পাতার ছানি,
একটুখানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি।
একটুখানি হাওয়া দিলেই ঘর নড়বড় করে,
তারি তলে আসমানীরা থাকে বছর ভরে।
পেটটি ভরে পায় না খেতে, বুকের ক-খান হাড়,
সাক্ষী দিছে অনাহারে কদিন গেছে তার।
মিষ্টি তাহার মুখটি হতে হাসির প্রদীপ-রাশি
থাপড়েতে নিবিয়ে গেছে দারুণ অভাব আসি।
পরনে তার শতেক তালির শতেক ছেঁড়া বাস,
সোনালি তার গা বরণের করছে উপহাস।
ভোমর-কালো চোখ দুটিতে নাই কৌতুক-হাসি,
সেখান দিয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু রাশি রাশি।
বাঁশির মতো সুরটি গলায় ক্ষয় হল তাই কেঁদে,
হয়নি সুযোগ লয় যে সে-সুর গানের সুরে বেঁধে।
আসমানীদের বাড়ির ধারে পদ্ম-পুকুর ভরে
ব্যাঙের ছানা শ্যাওলা-পানা কিল্-বিল্-বিল্ করে।
ম্যালেরিয়ার মশক সেথা বিষ গুলিছে জলে,
সেই জলেতে রান্না-খাওয়া আসমানীদের চলে।
পেটটি তাহার দুলছে পিলেয়, নিতুই যে জ্বর তার,
বৈদ্য ডেকে ওষুধ করে পয়সা নাহি আর।
...

রাখাল ছেলে / জসীম উদদীন

...
'রাখাল ছেলে ! রাখাল ছেলে ! বারেক ফিরে চাও,
বাঁকা গাঁয়ের পথটি বেয়ে কোথায় চলে যাও ?'

'ওই যে দেখ নীল-নোয়ান সবুজ ঘেরা গাঁ,
কলার পাতা দোলায় চামর শিশির ধোয়ায় পা;
সেথায় আছে ছোট্ট কুটির সোনার পাতায় ছাওয়া,
সাঁঝ-আকাশের ছড়িয়ে-পড়া আবির-রঙে নাওয়া;
সেই ঘরেতে একলা বসে ডাকছে আমার মা
সেথায় যাব, ও ভাই এবার আমায় ছাড় না !'

'রাখাল ছেলে ! রাখাল ছেলে ! আবার কোথায় ধাও,
পূব আকাশে ছাড়ল সবে রঙিন মেঘের নাও।'

মামার বাড়ি / জসীম উদদীন

...
আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা,
              ফুল তুলিতে যাই,
ফুলের মালা গলায় দিয়ে
              মামার বাড়ি যাই।
মামার বাড়ি পদ্মপুকুর
              গলায় গলায় জল,
এপার হ'তে ওপার গিয়ে
              নাচে ঢেউএর দল।
দিনে সেথা ঘুমিয়ে থাকে
              লাল শালুকের ফুল,
রাতের বেলা চাঁদের সনে
              হেসে না পায় কূল।
আম-কাঁঠালের বনের ধারে
              মামা-বাড়ির ঘর,
আকাশ হতে জোছনা-কুসুম
              ঝরে মাথার' পর।
রাতের বেলা জোনাক জ্বলে
              বাঁশ-বাগানের ছায়,
শিমুল গাছের শাখায় বসে
              ভোরের পাখি গায়।
ঝড়ের দিনে মামার দেশে
              আম কুড়াতে সুখ
পাকা জামের শাখায় উঠি
              রঙিন করি মুখ।
কাঁদি-ভরা খেজুর গাছে
              পাকা খেজুর দোলে,
ছেলেমেয়ে, আয় ছুটে যাই
              মামার দেশে চলে।
...

মেঘনায় ঢল / হুমায়ুন কবির

...
শোন্ মা আমিনা, রেখে দে রে কাজ ত্বরা করে মাঠে চল,
এল মেঘনায় জোয়ারের বেলা এখনি নামিবে ঢল।
                নদীর কিনার ঘন ঘাসে ভরা
                মাঠ থেকে গরু নিয়ে আয় ত্বরা
করিস না দেরি--আসিয়া পড়িবে সহসা অথই জল
মাঠ থেকে গরু নিয়ে আয় ত্বরা মেঘনায় নামে ঢল।

এখনো যে মেয়ে আসে নাই ফিরে--দুপুর যে বয়ে যায়।
ভরা জোয়ারের মেঘনার জল কূলে কূলে উছলায়।
                নদীর কিনার জলে একাকার,
                যেদিকে তাকাই অথই পাথার,
দেখতো গোহালে গরুগুলি রেখে গিয়েছে কি ও পাড়ায় ?
এখনো ফিরিয়া আসে নাই সে কি ? দুপুর যে বয়ে যায়।

আমাদের গ্রাম / বন্দে আলী মিঞা

...
আমাদের ছোটো গাঁয়ে ছোটো ছোটো ঘর
থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর।
পাড়ার সকল ছেলে মোরা ভাই ভাই
একসাথে খেলি আর পাঠশালে যাই।
হিংসা ও মারামারি কভু নাহি করি,
পিতা-মাতা গুরুজনে সদা মোরা ডরি।

আমাদের ছোটো গ্রাম মায়ের সমান,
আলো দিয়ে বায়ু দিয়ে বাঁচাইছে প্রাণ।
মাঠ ভরা ধান আর জল ভরা দিঘি,
চাঁদের কিরণ লেগে করে ঝিকিমিকি।
আমগাছ জামগাছ বাঁশ ঝাড় যেন,
মিলে মিশে আছে ওরা আত্মীয় হেন।
সকালে সোনার রবি পূব দিকে ওঠে
পাখি ডাকে, বায়ু বয়, নানা ফুল ফোটে।
...

চাষী / রাজিয়া খাতুন চৌধুরাণী

...
সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা,
দেশ মাতারই মুক্তিকামী, দেশের সে যে আশা।
দধীচি কি তাহার চেয়ে সাধক ছিলেন বড় ?
পুণ্য অহ হবে নাক সব করিলেও জড়।
মুক্তিকামী মহাসাধক মুক্ত করে দেশ,
সবারই সে অন্ন জোগায় নাইক গর্ব লেশ।
ব্রত তাহার পরের হিত, সুখ নাহি চায় নিজে,
রৌদ্র দাহে শুকায় তনু, মেঘের জলে ভিজে।
আমার দেশের মাটির ছেলে, নমি বারংবার
তোমায় দেখে চূর্ণ হউক সবার অহংকার।
...

একটি সন্ধ্যা / অশোকবিজয় রাহা

...
বেতারে কার সেতার বাজে, বাঙলা খবর শেষ
শুনে শুনে পথ দিয়ে যাই, মনে সুরের রেশ,
মফস্বলের শহরতলি খানিকটা বন-ঘেঁষা,
ঝোপে ঝাড়ে সন্ধ্যা নামে বুনো গন্ধে মেশা,
বাঁকের মোড়েই হঠাৎ আসে রাঙা মাটির টিলা
ওর পিছনে উঁকি মারে পাহাড়টা একশিলা,
শেয়াল-ডাকা রাত্রি আসে যেই আসি ওর কাছে,
বাদুড়গুলা ঝাপটা মারে কাক-ডুমুরের গাছে,
মাথার উপর ডাকল পেঁচা, চমকে উঠি-আরে !
আধখানা চাঁদ আটকে আছে টেলিগ্রাফের তারে !
...

আমাদের দেশ / আ.ন.ম বজলুর রশীদ

...
আমাদের দেশ তারে কত ভালবাসি
সবুজ ঘাসের বুকে শেফালির হাসি,
মাঠে মাঠে চরে গরু নদী বয়ে যায়
জেলে ভাই ধরে মাছ মেঘের ছায়ায়।
রাখাল বাজায় বাঁশি কেটে যায় বেলা
চাষা ভাই করে চাষ কাজে নেই হেলা।
সোনার ফসল ফলে ক্ষেত ভরা ধান
সকলের মুখে হাসি, গান আর গান।
...

হেমন্ত / সুফিয়া কামাল

...
সবুজ পাতার খামের ভেতর
হলুদ গাঁদা চিঠি লিখে
কোন্ পাথারের ওপার থেকে
আনল ডেকে হেমন্তকে ?

আনল ডেকে মটরশুঁটি,
খেসারি আর কলাই ফুলে
আনল ডেকে কুয়াশাকে
সাঁঝ সকালে নদীর কূলে।

সকাল বেলায় শিশির ভেজা
ঘাসের ওপর চলতে গিয়ে
হাল্কা মধুর শীতের ছোঁয়ায়
শরীর ওঠে শিরশিরিয়ে।

গ্রীষ্মের দুপুরে / ফজলুর রহমান

...
ঘাম ঝরে
দরদর
           গ্রীষ্মের দুপুরে।
খাল বিল
চৌচির,
           জল নেই পুকুরে।
মাঠে ঘাটে
লোক নেই,
           খাঁ খাঁ করে রোদ্দুর !
পিপাসায়
পথিকের
           ছাতি কাঁপে দুদ্দুর।
রোদ যেন
নয়, শুধু
           গনগনে ফুলকি।
আগুনের
ঘোড়া যেন
           ছুটে চলে দুলকি।

টুনটুনি / আতোয়ার রহমান

...
টুনটুনিরে টুনটুনি, তুই উঠানে আয় এখ্খুনি
একটুখানি নাচ দেখি তোর, একটুখানি গান শুনি।
আয় বেঁধে পায় কুঁচের নূপুর বাউরি পাতার বোল নিয়ে।
মৌরি ফুলের টিপ পরে আয় ঝুমকো লতায় দোল দিয়ে।
মা রেখেছেন তিলের নাড়ু, খুকু দেবে ঝুনঝুনি,
খোকন দেবে লাল গামছা, নাচ দিখি তুই টুনটুনি।
...

ট্রেন / শামসুর রাহমান

...
ঝক ঝক ঝক ট্রেন চলেছে
রাত দুপুরে অই।
ট্রেন চলেছে, ট্রেন চলেছে
ট্রেনের বাড়ি কই ?

একটু জিরোয়, ফের ছুটে যায়
মাঠ পেরুলেই বন।
পুলের ওপর বাজনা বাজে
ঝন ঝনাঝন ঝন।

দেশ-বিদেশে বেড়ায় ঘুরে
নেইকো ঘোরার শেষ।
ইচ্ছে হলেই বাজায় বাঁশি,
দিন কেটে যায় বেশ।

থামবে হঠাৎ মজার গাড়ি
একটু কেশে খক।
আমায় নিয়ে ছুটবে আবার
ঝক ঝকাঝক ঝক।
...

কেমন বড়াই / হাবীবুর রহমান

...
লোকটা শুধু করত বড়াই--
'দেখে নিতাম লাগলে লড়াই !'
উইঢিবিতে মারতো ঘুষি
চোখ পাকিয়ে জোরসে ঠুসি।
বাহু ঠুকে ফুলিয়ে ছাতি
বলত- 'আসুক বাঘ কি হাতি !
আমি কি আর কারেও ডরাই ?
ভাঙতে পারি লোহার কড়াই।'
শুনে সবে কাঁপত ডরে,
খিল লাগিয়ে থাকত ঘরে।
এক দিন এক ভোরের বেলায়
বেবাক লোকের ঘুম ভেঙে যায়,
ঘর ছেড়ে সব বাইরে এসে
বাড়িয়ে গলা দেখল শেষে;
ঢিবির পাশে বাঁধের গোড়ায়,
লোকটা কেবল গড়িয়ে বেড়ায়।

সকাল / হাবীবুর রহমান

...
কাঁচা কাঁচা রোদ মাখা সকাল বেলা,
আকাশে ভাসাল আজ আলোর ভেলা।
           গাছে গাছে চিকচিক
           আলো হাসে ফিকফিক
চালে চালে ঝিকঝিক এ কোন্ খেলা !
কাঁচা সোনা রোদ মাখা সকাল বেলা।

শাখে শাখে সে আলোর পরশ লাগে।
দিকে দিকে যেন কোন জীবন জাগে।
           ফুলে ফুলে উতরোল
           জাগরণ কলরোল
বাতাসেতে হিল্লোল প্রভাতী ফাগে !
দিকে দিকে জীবনের পরশ লাগে !

এসো আজ মুঠি মুঠি মাখি সে আলো
ধুয়ে যাক মুছে যাক মনের কালো।
           এ আলোর কুমকুম
           দিয়ে যাক রাঙাচুম
মন জুড়ে রেখে যাক অনেক ভালো।
এসো ভাই মুঠি মুঠি মাখি এ আলো।
...

বাক্ বাক্ কুম / রোকনুজ্জামান খান

...
বাক্ বাক্ কুম পায়রা
মাথায় দিয়ে টায়রা
বউ সাজবে কাল কি ?
চড়বে সোনার পালকি ?

পালকি চলে ভিন্ গাঁ-
ছয় বেহারার তিন পা।
পায়রা ডাকে বাকুম বাক্
তিন বেহারার মাথায় টাক।
বাক্ বাকুম কুম্ বাক্ বাকুম
ছয় বেহারার নামলো ঘুম।
থামলো তাদের হুকুম হাঁক
পায়রা ডাকে বাকুম্ বাক্।

ছড় বেহারা হুমড়ি খায়
পায়রা উড়ে কোথায় যায় ?
...

বৃষ্টির ছড়া / ফররুখ আহমেদ

...
বিষটি এল কাশ বনে
জাগল সাড়া ঘাস বনে,
বকের সারি কোথা রে
লুকিয়ে গেল বাঁশ বনে।

নদীতে নাই খেয়া যে,
ডাকল দূরে দেয়া যে,
কোন্ সে বনের আড়ালে
ফুটল আবার কেয়া যে।

গাঁয়ের নামটি হাটখোলা,
বিষটি বাদল দেয় দোলা,
রাখাল ছেলে মেঘ দেখে,
যায় দাঁড়িয়ে পথ-ভোলা।

মেঘের আঁধার মন টানে,
যায় সে ছুটে কোন খানে,
আউশ ধানের মাঠ ছেড়ে
আমন ধানের দেশ পানে।
...

স্বদেশ / আহসান হাবীব

...
এই যে নদী
নদীর জোয়ার
নৌকা সারে সারে,
একলা বসে আপন মনে
বসে নদীর ধারে
এই ছবিটি চেনা।

মনের মধ্যে যখন খুশি
এই ছবিটি আঁকি
এক পাশে তার জারুল গাছে
দুটি হলুদ পাখি,
এমনি পাওয়া এই ছবিটি
কড়িতে নয় কেনা।

Saturday, May 22, 2010

গাধার কান / রোকনুজ্জামান খান

...
একটা দড়ির দুদিক থেকে টানছে দুদল ছেলে
তাই না দেখে বনের বানর লাফায় খেলা ফেলে।
সকল বানর ফন্দি আঁটে জবর মজার খেলা
এমন খেলা খেলেই সবাই কাটিয়ে দেবে বেলা।

কিন্তু দড়ি মিলবে কোথায় ? ঘাবড়ে গেল মাথা
পালের সেরা বানর বলে মগজ তোদের যা-তা।
নেইকো দড়ি বয়েই গেল ভাবিস মিছে হাবা
লেজে লেজে ধরব টেনে হবে দড়ির বাবা।

সফদার ডাক্তার / হোসনে আরা

...
সফদার ডাক্তার মাথাভরা টাক তার
খিদে পেলে পানি খায় চিবিয়ে,
চেয়ারেতে রাতদিন বসে গোণে দুই-তিন
পড়ে বই আলোটারে নিভিয়ে।

ইয়া বড় গোঁফ তার, নাই যার জুড়িদার
শুলে তার ভুঁড়ি ঠেকে আকাশে,
নুন দিয়ে খায় পান, সারাক্ষণ গায় গান
বুদ্ধিতে অতি বড় পাকা সে।

রোগী এলে ঘরে তার, খুশিতে সে চারবার
কষে দেয় ডন আর কুস্তি,
তারপর কোগীটারে গোটা দুই চাঁটি মারে
যেন তার সাথে কত দুস্তি।

শাড়ি / সুবোধ সরকার

...
বিয়েতে একান্নটা শাড়ি পেয়েছিল মেয়েটা
অষ্টমঙ্গলায় এসে আরো ছটা
এতো শাড়ি একসঙ্গে সে জীবনে দেখেনি।

আলমারির প্রথম থাকে সে রাখল সব নীল শাড়িদের
হালকা নীল একটাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তুই আমার আকাশ
দ্বিতীয় থাকে রাখল সব গোলাপীদের
একটা গোলাপীকে জড়িয়ে সে বলল, তোর নাম অভিমান
তৃতীয় থাকে তিনটি ময়ূর, যেন তিনদিক থেকে ছুটে আসার সুখ
তেজপাতা রং যে শাড়িটার, তার নাম দিল বিষাদ।
সারা বছর সে শুধু শাড়ি উপহার পেল
এত শাড়ি সে কী করে এক জীবনে পরবে ?

কাকাতুয়া / যোগীন্দ্রনাথ সরকার

...
কাকাতুয়া, কাকাতুয়া, আমার যাদুমণি,
সোনার ঘড়ি কি বলিছে, বল দেখি শুনি ?

বলিছে সোনার ঘড়ি, "টিক্ টিক্ টিক্,
যা কিছু করিতে আছে, করে ফেল ঠিক।
          সময় চলিয়া যায়-
          নদীর স্রোতের প্রায়,
যে জন না বুঝে, তারে ধিক্ শত ধিক।"
বলিছে সোনার ঘড়ি, "টিক্ টিক্ টিক্।"

কাকাতুয়া, কাকাতুয়া, আমার যাদুধন,
অন্য কোন কথা ঘড়ি বলে কি কখন ?

মাঝে মাঝে বল ঘড়ি, "টঙ্-টঙ্-টঙ্,
মানুষ হইয়ে যেন হয়ো না ক সঙ।
          ফিটফিটে বাবু হলে,
          ভেবেছ কি লবে কোলে ?
পলাশে কে ভালবাসে দেখে রাঙা রঙ্।"
মাঝে মাঝে বলে ঘড়ি, "টঙ্-টঙ্-টঙ্।"
...

মুখোশ, মুখোশ শুধু / পবিত্র মুখোপাধ্যায়

...
মুখোশ, মুখোশ শুধু, চারিদিকে মুখোশের ভিড়;
আমাকে অস্থির
ক'রে তোলে, নিরুপায় হয়ে তুলি হাত
আকাশে,... খটখটে মেঘ-রোদ্দুরের অনির্বচনীয়
সুন্দর নির্মাণ করে চিরায়ত
আর এক পৃথিবী;
আমি চেয়ে থাকি নির্নিমেষ।

এখন মুখোশ যুদ্ধে কেউই পরে না ছদ্মবেশ,
স্বাভাবিক দেখে ভাবি- আড়ালে
নেকড়ের চোখ জ্বলে;
ধারালো নখের লক্ষ্য ঢেকেছে আস্তিনে।
আমি অক্ষরের যাদুবলে
মুখোশের আড়ালে যে মুখ, তাকে চিনে
নিতে গিয়ে দেখি, তাও
প্লাস্টিক সার্জারী করা, অন্য আগন্তুক।

বাড়ি / তালিম হোসেন

...
অবশেষে
বাড়ি বানালাম একটা।
আমি এখন এই মহানগরে
একটা বাড়ির মালিক।

বেশ বড়সড়ো-
দক্ষিণে প্রকাণ্ড লন
বড় ড্রয়িংরুম
শোবার ঘর অনেকগুলো-
ছেলেরা থাকবে
মেয়েরা, জামাইরা এলে থাকবে।

মাস্টার বেড রেখেছি একেবারে
ভেতরের দিকে,
আর দক্ষিণ দিকে বড় বড় জানালা,
নিজে থাকব আরাম করে,
সারা বাড়ির ঝামেলা এখানে পৌঁছুবে না।
এ ঘর থেকে বেরুবার দরজা
সিটিং পারলারের দিকে-
সেখান থেকে করিডোর দিয়ে
পাশে অন্যান্য ঘর পেরিয়ে
তারপর ড্রয়িংরুম।

একটি পাখির পট আঁকার জন্যে / জাক প্রেভ্যাখ

...
প্রথমে আঁকতে হবে একটি খাঁচা
একটি খোলা দরজা থাকবে ওতে
তারপর আঁকতে হবে
সুন্দর কিছু
সাধারণ কিছু
দরকারী কিছু
পাখির জন্যে
এরপর ক্যানভাসটি রাখতে হবে একটা গাছের গায়ে হেলান দিয়ে
কোন বাগানে
কোন বনে
অথবা কোন অরণ্যে
লুকিয়ে থাকতে হবে গাছের পেছনে
কিচ্ছুটি না বলে
একদম নড়াচড়া না করে
কখনও পাখি তাড়াতাড়িই চলে আসে
কিন্তু কখনও আবার সময় নিতে পারে বছরের পর বছর

কবি কাহিনী / আশরাফ আল দীন

...
একজন রণেভঙ্গ দেয়া কবির কাহিনী শুনুন।
একবার কবির উপর বদনজর পড়লো এক পরীর,
চাঁদে-পাওয়া মানুষের মতো
             কবি আরো কবি হয়ে গেল !
এই বহু-কবির দেশেও এতটুকু কবি হওয়া
             কাউকে কি মানায় বলুন ?
সেই কবি হা-বৃষ্টি চাতকের মতো ঘোরে
পরিচ্ছন্ন আকাশী সীমাহীনতায় ওড়ে, আর
যতবার বলে, মেঘ দে' পানি দে'
তার চেয়ে বেশি বলে, ভালবাসা দে' ভালবাসা দে' !

নিরঞ্জনের লাশ / আকা ফিরোজ আহমেদ

...
(জগন্নাথ হল দুর্ঘটনা যার উৎস)

মরার আগে নিরঞ্জনকে তোমরা চিনতে না।
আমি ওকে চিনতাম ও যখন জীবিত ছিলো
মরার পর ওকে আমি চিনতে পারিনি
বিশ্বাস করো ওকে আমি চিনতে পারিনি।

ভাঙা ছাদের নীচ থেকে
নিষ্প্রাণ গাদা গাদা হাড় মাংস এনে তোমরা বলেছো,
এ নিরঞ্জন
আমি চিৎকার করে বলেছি, না
বিচূর্ণ মস্তক দেখিয়ে বলেছো, এ নিরঞ্জনের মাথা
আর কোন দিন কথা বলবে না
আমি চিৎকার করে বলেছি, না
ছিন্ন হাত দেখিয়ে তোমরা বলেছো,
এ-তো নিরঞ্জনের হাত, দেখো সেই কালো তিল
আমি বলেছি, না, না
ঠিকরে পড়া চোখ, চাপ চাপ রক্ত, ভাঙা দাঁত
ছিটকে যাওয়া মগজ ওসব কিছুই নিরঞ্জনের নয়।

যেতে যেতে / সুভাষ মুখোপাধ্যায়

...
তারপর যে-তে যে-তে যে-তে
এক নদীর সঙ্গে দেখা।

পায়ে তার ঘুঙুর বাঁধা
পরনে
উড়ু-উড়ু ঢেউয়ের
নীল ঘাগরা।

সে নদীর দুদিকে দুটো মুখ।
এক মুখে সে আমাকে আসছি বলে
দাঁড় করিয়ে রেখে
অন্য মুখে
ছুটতে ছুটতে চলে গেল।

আর
যেতে যেতে বুঝিয়ে দিল
আমি অমনি করে আসি
অমনি করে যাই।
বুঝিয়ে দিল
আমি থেকেও নেই,
না থেকেও আছি।

দীপ্তি / সাযযাদ কাদির

...
দীপ্তি, আমার স্বপ্ন কোনও স্বপ্ন ছিল না-
              ছিল নিদ্রার ব্যাঘাত মাত্র।
দীপ্তি, আমার প্রেমও হৃদয়ঘটিত কিছু ছিল না-
              ছিল শতকরা দু'-তিন শ' ভাগ পাগলামি।

দীপ্তি, আমার কান্না যেমন ছিল
              এক প্রকার চোখের অসুবিধা
              তেমন আমার ওই মরে যাওয়াটাও হবে
              দু'চোক বুজে মটকা মেরে
              পড়ে থাকার মতো একটা ব্যাপার।

দীপ্তি, মানুষ দুর্বিপাকে দরিদ্র হয়ে পড়ে,
              কিন্তু দরিদ্র কখনও মানুষ হতে পারে না।
              তাই সে স্বপ্ন দেখে না,
              প্রেম জানে না,
              তার মরে যাওয়াটাও শেষ পর্যন্ত কোনও যাওয়া নয়।
...

নীলার স্বপ্নচুরি / সৈয়দ রেজাউর রহমান

...
কখনো কখনো মনে হয়
নীলার স্বপ্নগুলো ছোঁ মেরে নিয়ে যেতে
কারণ ওর স্বপ্নে রয়েছে শঠতা, আছে সংকীর্ণতা।
ওর স্বপ্ন জুড়ে আছে পঙ্কিলতা।
নীলা বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়াতে বড্ড ভয় পায়
ও ভীরু নিভৃতচারিণী।
শুধু একপেশে সুখময়তা যেনো ছেয়ে আছে
তাই আমি ওর স্বপ্নগুলো চুরি করতে চাই।
ওর স্বপ্নের ভাণ্ডার কত দিনে শেষ হবে জানিনা
শুধু জানি স্বপ্ন খোয়া গেলে ও তিলে তিলে নিঃশেষ হবে।

অষ্টপ্রহরিকা / সানাউল হক

...
সন্ধ্যায় তুমি আসবে বলে
একটি সম্পূর্ণ বিকেলকে আমি
কাঠের সিঁড়িতে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলাম।

রাত্রে তোমার সময় হবে জেনে
একটি দিনকে তাড়াহুড়োর ছুঁতোয়
ক্ষুদ্র সম্ভাষণে বিদায় দিয়েছিলাম।

ভোরে তুমি পদ্মিনী শুভ্রতা হবে বলে
আমি রাত্রির সমস্ত বাতিগুলো
স্বহস্তেই নিভিয়ে দিয়েছিলাম।

এবং দুপুরে তুমি শঙ্খিনী হবে স্থিরতায়
টেলিফোন, ঘুঘু ও কাককে
আমার চৌহদ্দিতে আসতে বারণ করেছিলাম।

এবং সায়াহ্নে তুমি আসবে প্রত্যয়ে
আমি দিবানিদ্রাকে রাত্রির অন্ধকারে
একটি দিনের জন্য ছুটি দিয়েছিলাম।
...

নোট বই থেকে / সৈয়দ শামসুল হক

...
একদিন দুপুর-রোদ্দুরে তুমি নিয়ে এলে একখণ্ড নীল-
তোমার সূতির শাড়ি, সমুদ্রের সাথে যার অনিবার্য মিল;
আয়োজনে সে যেমন ঘিরে আছে পৃথিবীকে, শাড়িও তোমাকে
জীবনের বিপুল রহস্যগুলো সমুদ্রই চুরি করে রাখে।
...

আরো একজন / সৈয়দ শামসুল হক

...
যেখানেই যাও তুমি, যেখানেই যাও
সঙ্গে যায় আরো একজন;
যদিও অদূরে তবু তার দূরত্ব ভীষণ।

যেখানেই দৃষ্টি দাও, যেখানেই দাও
দৃষ্টি দেয় আরো একজন;
যদিও সুনীল তবু সেখানেই মেঘের গড়ন।

যাকেই যে কথা বলো, যাকেই যে কথা
শুনে যায় আরো একজন;
যদিও নিশ্চুপ তবু অবিরাম পদ্মার ভাঙন।

যেখানেই রাখো হাত, যেখানেই রাখো
রাখে হাত আরো একজন;
যদিও নিশ্চল তবু দ্রুত তার শিরায় স্পন্দন।

যখন শয্যায় তুমি, যখন শয্যায়
পাশে আছে আরো একজন;
যদিও ঘনিষ্ঠ তবু ঘুম কেড়ে নিয়েছে কখন।

তুমি কি দেখেছো তাকে ? চেনো তাকে ?
সচকিত মাঝে মাঝে তাই ?
তোমার সম্মুখে তবে আমি এসে আবার দাঁড়াই ?
...

প্রেম ও পরিণয় / শিমুল মোস্তফা

...
তুমি আমায় ভালোবাসতেই
               আমি তোমার চোখকে ছুঁ'লাম।
তুমি আমায় ভালোবাসতেই
               আমি তোমার ঠোঁটকে ছুঁ'লাম।
তুমি আমায় ভালোবাসতেই
               আমি তোমায় স্পর্শে নিলাম।
তুমি আমায় ভালোবাসতেই
               আমি তোমায় ছোবল দিলাম।
তুমি আমায় ভালোবাসতেই
               আমি তোমায় আদর দিলাম।
তুমি আমায় ভালোবাসতেই
               অপূর্ব এক ঘর বানালাম।

আমি তোমায় ভালোবাসতেই
               তুমি আমার কাছে এসে বল্লে-
"ওগো প্রেমের জন্য পরিণয়
               পরিণয়ের জন্য প্রেম নয়"।
...

বাইবেলের কালো অক্ষরগুলো / শামসুর রাহমান

...
জো, তুমি আমাকে চিনবে না। আমি তোমারই মতো
একজন কালো মানুষ গলার সবচেয়ে
উঁচু পর্দায় গাইছি সেতুবন্ধের গান, যে গানে
তোমার দিলখোলা সুরও লাগছে।

জো, যখন ওরা তোমার চামড়ায় জ্বালা-ধরানো
সপাং সপাং চাবুক মারে আর
হো হো করে হেসে ওঠে,
যখন ওরা বুটজুতোমোড়া পায়ে মারে তোমাকে,
তখন ধূলায় মুখ থুবড়ে পড়ে মানবতা।
জো, যখন ওরা তোমাকে
হাত পা বেঁধে নির্জন রাস্তায় গার্বেজ ক্যানের পাশে
ফেলে রাখে, তখন ক্ষ্যাপাটে অন্ধকারে
ভবিষ্যৎ কাতরাতে থাকে
গা' ঝাড়া দিয়ে ওঠার জন্যে।
যদিও আমি তোমাকে কখনো দেখিনি জো,
তবু বাইবেলের কালো অক্ষরের মতো তোমার দুফোঁটা চোখ
তোমার বেদনার্ত মুখ বারংবার
ভেসে ওঠে আমার হৃদয়ে, তোমার বেদনা
এশিয়া, আফ্রিকা আর লাতিন আমেরিকায় ব্যাপ্ত, জো।

ফোন কার্ড / রবিশঙ্কর মৈত্রী

...
--হ্যালো, আমি।
--তুমি কি জানতে ধরব আমি ?
--টের পাই, বোতাম চাপতেই বুঝি তুমি আসছ কাছে।
--খুব হয়েছে। বলো, কেন এ অবেলায়।
--কাল এলে না যে।
--মেঘ মেঘ করছিল, বিকেলে আকাশ দেখনি ?
--দেখেছি, কিন্তু জানি তো- আড়ালে তার সূর্য হাসে।
--না কাল হাসেনি। সে পালিয়েছে।
--মেঘ এসে কাল আমার জানালাতেও থাবা বসিয়েছিল।
--তোমাকে ধরেছিল ?
--দারুণ হত, এক দমকা হাওয়া দিয়েই ঝরে পড়ল মুষল ধারে।
--আর আমাকে ভিজিয়ে দিল, জলকাদায় দাঁড়িয়ে থাকলাম সন্ধে অব্দি
--তুমি যে কী, মেঘ দেখেই বোঝনি আমি আসছি না।
--বুঝেছি, মেঘের পরেও তো আসতে পারো তাই...
--ভেজা মাথায় দাঁড়িয়েছিলে, খুব হয়েছে। ঠাণ্ডা বসেনি তো ?
--না, দাঁড়িয়ে আছে তোমার জন্যে...
--বাজে বকো না।
--শোনো আমার লাস্ট ইউনিট চলছে...
--আমার যে এক্ষুণি আরো কিছু কথা না-বললেই নয়
--ফোন কার্ডের ইউনিট শেষ হতে চলেছে।
আর একটু পরেই দুজনেই না-বলা কথা বুকে নিয়ে
মৃত শরীর নিয়ে অক্ষত ফোন কার্ড ফিরে আসবে হাতে।
সুন্দর অক্ষত মৃত শরীর, কিন্তু মূল্যহীন,
মানিব্যাগে জায়গা হবে না, ফেলে দেব ময়লা বাক্সে।
--তুমি খুব নিষ্ঠুর কথা বলো। শুনতে ভীষণ লাগে।... হ্যালো হ্যালো হ্যালো...
...

পরাণ মাঝি হাঁক দিয়েছে / রাম বসু

...
অনেকক্ষণ বৃষ্টি থেমে গেছে
বৃষ্টি থেমে গেছে অনেকক্ষণ,
ফুটো চাল থেকে আর জল গড়িয়ে পড়বে না
খোকাকে শুইয়ে দাও।

খোকাকে শুইয়ে দাও
তোমার বুকের ওম থেকে নামিয়ে
ওই শুকনো জায়গাটায় শুইয়ে দাও,
গায়ে কাঁথাটা টেনে দাও
অনেকক্ষণ বৃষ্টি থেমে গেছে।

মেঘের পাশ দিয়ে কেমন সরু চাঁদ উঠেছে
তোমার ভুরুর মতো সরু চাঁদ
তোমার চুলের মতো কালো আকাশে,
বর্ষার ঘোলা জল মাঠ ছাপিয়ে নদীতে মিশে গেছে
কুমোরপাড়ার বাঁশের সাঁকোটা ভেঙে গেছে বোধহয়
বোধহয় ভেসে গেছে জলের তোড়ে
অভাবের টানে যেমন আমাদের আনন্দ ভেসে যায়।

গাছের জন্য তোমার জন্য / রাণা চট্টোপাধ্যায়

...
আমার হাতে অগ্নিগোলক তোমার হাতে নিশান
তোমার চোখে স্তব্ধ আকাশ আমার চোখে বিষাণ।
শহর আমায় জড়িয়ে আছে শীত নেমেছে পথে
এবার আমি রাজার রাজা তোমায় নিলাম সাথে।

আমার হাতে সুরের চিহ্ন তুমিই ভাগ্যরেখা
জন্ম থেকে বসিয়ে রাখো এবার পাবো দেখা।
যেহেতু আর ভীষণ একা অগ্নিগোলক হাতে
তোমায় নিয়ে মিথুন নদী পারব কি সাঁতরাতে ?
জ্বলছে শীতের তীব্র বিষে দোলাও নিশান
নরম ঠোঁটের ভালোবাসায় বস্তুবাদীর কৃপান ?
অগ্নিনারী জমি দিও তিন হাত মাটির ভূদান।

ভালোবাসার সংজ্ঞা / রফিক আজাদ

...
ভালোবাসা মানে দুজনের পাগলামি,
পরস্পরকে হৃদয়ের কাছে টানা;
ভালোবাসা মানে জীবনের ঝুঁকি নেয়া,
বিরহ-বালুতে খালিপায়ে হাঁটাহাঁটি;
ভালোবাসা মানে একে অপরের প্রতি
খুব করে ঝুঁকে থাকা;
ভালোবাসা মানে ব্যাপক বৃষ্টি, বৃষ্টির একটানা
ভিতরে-বাহিরে দুজনের হেঁটে যাওয়া;
ভালোবাসা মানে ঠাণ্ডা কফির পেয়ালা সামনে
অবিরল কথা বলা;
ভালোবাসা মানে শেষ হয়ে-যাওয়া কথার পরেও
মুখোমুখি বসে থাকা।
...

অনন্ত প্রেম / রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

...
তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি শত রূপে শতবার
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।
চিরকাল ধরে মুগ্ধ হৃদয় গাঁথিয়াছে গীতহার-
কত রূপ ধরে পরেছ গলায়, নিয়েছ সে উপহার
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।

যত শুনি সেই অতীত কাহিনী, প্রাচীন প্রেমের ব্যথা,
অতি পুরাতন বিরহমিলন কথা,
অসীম অতীতে চাহিতে চাহিতে দেখা দেয় অবশেষে
কালের তিমির রজনী ভেদিয়া তোমারি মুরতি এসে
চিরস্মৃতিময়ী ধ্রুবতারকার বেশে।

আমরা দুজনে ভাসিয়া এসেছি যুগলপ্রেমের স্রোতে
অনাদি কালের হৃদয় উৎস হতে।
আমরা দুজনে করিয়াছি খেলা কোটি প্রেমিকের মাঝে
বিরহবিধুর নয়নসলিলে, মিলনমধুর লাজে-
পুরাতন প্রেম নিত্যনতুন সাজে।

মনে পড়া / রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

...
মাকে আমার পড়ে না মনে।
শুধু কখন খেলতে গিয়ে হঠাৎ অকারণে
একটা কী সুর গুনগুনিয়ে কানে আমার বাজে,
মায়ের কথা মিলায় যেন আমার খেলার মাঝে।
মা বুঝি গান গাইত আমার দোলনা ঠেলে ঠেলে-
মা গিয়েছে, যেতে যেতে গানটি গেছে ফেলে।

মাকে আমার পড়ে না মনে।
শুধু যখন আশ্বিনেতে ভোরে শিউলিবনে
শিশির-ভেজা হাওয়া বেয়ে ফুলের গন্ধ আসে
তখন কেন মায়ের কথা আমার মনে ভাসে।
কবে বুঝি আনত মা সেই ফুলের সাজি বয়ে-
পূজোর গন্ধ আসে যে তাই মায়ের গন্ধ হয়ে।

মাকে আমার পড়ে না মনে।
শুধু যখন বসি গিয়ে শোবার ঘরের কোণে,
জানলা থেকে তাকাই দূরে নীল আকাশের দিকে-
মনে হয় মা আমার পানে চাইছে অনিমিখে।
কোলের পরে ধরে কবে দেখত আমায় চেয়ে,
সেই চাউনি রেখে গেছে সারা আকাশ ছেয়ে।
...

চিল্কায় সকাল / বুদ্ধদেব বসু

...
কী ভালো আমার লাগলো আজ এই সকালবেলায়
কেমন করে বলি।
কী নির্মল নীল এই আকাশ, কী অসহ্য সুন্দর,
যেন গুণীর কণ্ঠের অবাধ উন্মুক্ত তান
দিগন্ত থেকে দিগন্তে;
কী ভালো আমার লাগলো এই আকাশের দিকে তাকিয়ে,
চারদিক সবুজ পাহাড়ে আঁকাবাঁকা, কুয়াশার ধোঁয়াটে,
মাঝখানে চিল্কা উঠছে ঝিলকিয়ে।

তুমি কাছে এলে, একটু বসলে, তারপর গেলে ওদিকে,
ইস্টেশনে গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে, তা-ই দেখতে।
গাড়ি চলে গেলো ! কী ভালো তোমাকে বাসি,
কেমন করে বলি।

তুমি আনন্দ করো / ব্রত চক্রবর্তী

...
তোমার বিরহ আমাকে দাও;
তুমি আনন্দ করো।

তোমার দুঃখগুলি আমাকে দাও;
তুমি আনন্দ করো।

তোমার ভুলগুলি এসে বিঁধুক আমাকে;
তুমি আনন্দ করো।

তোমার বিষাদ এসে ফালা ফালা করুক আমাকে;
তুমি আনন্দ করো।

তোমার পথশ্রম, জীবন জীবন ভার
আমি সইতে বইতে পারবো।
দাও আমাকেই।
তুমি আনন্দ করো।

আলোক বর্তিকা / বিমল গুহ

...
আগুন আকাশকে ছুঁতে পারে না
বিশ্বাস আকাশকে ছোঁয়,
বাতাস পাহাড়কে নাড়াতে পারে না
প্রেম পাহাড়কে নাড়ায়,
আকাশের দিকে তাকাতে তাকাতে চোখে রক্তগোলাপ ফুটে আছে
পাহাড়ের গায়ে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হবো কি-দাক্ষায়ণী ?

বিষাদগ্রস্ত মানুষের মুখ দেখলে আমার আগুনের কথা মনে পড়ে
আমি আলোক বর্তিকা হাতে তোমাকে খুঁজি,
তোমার উদ্দীপ্ত ইচ্ছার কথা ভাবলে
তিল তিল জন্ম নেয় রক্তকণিকায় স্পন্দন
আমি নবসৃষ্টির রূপকার।

অবজ্ঞা / বিমল গুহ

...
তোমার অবজ্ঞা পেয়ে ভালবাসা তীব্র হলো আরো।
বিনয় তাড়িত রাত খুলে দেয় চোখের সম্মুখে অন্ধকার
আমিও শরীর আড়মোড়া কেটে দু'পায়ে সরাই বেদনাকে
বিছানার চাদর যেনো রাতভর মলিনতা ধারণ করেছে।
মাঝে মধ্যে নীলিমায় টুকরো টুকরো দুঃখ ছুঁড়ে ফেলি,
টুকরো টুকরো ভালবাসা টুকরো টুকরো গড়িমসি-
দেখি, আমার শরীর জুড়ে ঝাঁকঝাঁক পাখির কুজন
আমাকে পাগল হাওয়ায় দোল দেয়-
             বেদনা ভোলায়
আমাকে দু'হাত ধরে নিয়ে যায় নদীর ওপারে
ভালবাসা যেখানে শিখেছে গড়িমসি।
আমি কবর জেয়ারতের মতো সেইখানে
ফেলেছি চোখের জল ভাগ করে নিয়েছি বিশ্বাস বার বার
আহত হয়েছি। ফিরে এসে দেখি ঘরে
একটি চড়ুই কিচির মিচির শব্দে
আছড়ে পড়ে জানালার শিকে
সেও কি বেদনা বোঝে আমার মতোন,
আমার মতোন সে কি দুঃখী ও বেদনাপীড়িত !

তোমার অবজ্ঞা পেয়ে ভালবাসা তীব্র হলো আরো,
তোমার অবজ্ঞা দেখে একটি চড়ুই এসে বেদনাকে
             ভাগ করে নেয়।
...

কথাবার্তা / প্রমোদ বসু

...
হু আর ইউ ?
'ইংরেজি জানি না যে, ভেউ-ভেউ-ভেউ...'

ডোন্ট ক্রাই প্লীজ--
'শী যে ছাই বলছেন হিজিবিজবিজ্-'

মাই বয়, আই ডোন্ট লাইক এ ফুল।
'আমিও যে চোখে দেখি সরষের ফুল !'

ডোন্ট গেট নার্ভাস, লিশন্ টু মি--
'কী সাহসে আমাকে যে বলছেন 'তুমি' !'

ইয়েস ! আই অলওয়েজ লিশন্ টু ইউ।
'আমাকে বাঁচান দাদা, ভেউ-ভেউ-ভেউ...'

মাই গড ! ও ডিয়ার, ডোন্ট ক্রাই প্লীজ।
'এইবার বুঝেছি যে আপনি কী চিজ !'

অফকোর্স। ইউ আর হাংরি এনাফ।
'দয়া করে ছেড়ে দিন- এই চাই মাফ।'

হাউ ফুল ইউ আর ! আই অ্যাম সরি।
'সরতে আমিও চাই। আজ কেটে পড়ি।'
...

তুমি এলে / পূর্ণেন্দু পত্রী

...
তুমি এলে সূর্যোদয় হয়।
পাখি জাগে সমুদ্রের ঘাটে
গন্ধের বাসরঘর জেগে ওঠে উদাসীন ঘাসের প্রান্তরে
হাড়ের শুষ্কতা, ভাঙা হাটে।

তুমি এলে চাঁদ ওঠে চোখে
সুস্বাদু ফলের মত পেকে 'পরিপূর্ণ হয়
ইচ্ছা, প্রলোভন,
ঘরের দেয়াল ভেঙে ঘরে ঢুকে পড়ে দূর
ভ্রমণের বন।

তুমি এলে মেঘ বৃষ্টি সবই মূল্যবান।
আমাদের কাঠের চেয়ার
যেদিকে শহর নেই, শ্রাবণের মেঘমল্লার
মাতাল নৌকার মত ভেসে যায় ভবিষ্যৎহীন।
পৃথিবী পুরনো হয়
পৃথিবীর ছাইগাদা, ছন্নছাড়া দৃশ্যের বিভূঁয়ে
শতাব্দীর শোক-তাপ জ্বর-জ্বালা ছুঁয়ে
রয়ে যাই আমরা নবীন।
...

সরোদ বাজাতে জানলে / পূর্ণেন্দু পত্রী

...
আমার এমন কিছু দুঃখ আছে যার নাম তিলক-কামোদ
এমন কিছু স্মৃতি যা সিন্ধুভৈরবী
জয়জয়ন্তীর মত বহু ক্ষত রয়ে গেছে ভিতরে দেয়ালে
কিছু কিছু অভিমান
ইমন-কল্যাণ।
সরোদ বাজাতে জানলে বড় ভাল হতো।
পুরুষ কীভাবে কাঁদে সে-ই শুধু জানে।
কার্পেট সাজানো প্রিয় অন্তঃপুরে ঢুকে গেছে জল।
মুহুর্মুহু নৌকোডুবি, ভেসে যায় বিরুদ্ধ নোঙর।
পৃথিবীর যাবতীয় প্রেমের সপ্তডিঙা ডুবছে যেখানে
সেখানে নারীর মত পদ্ম ফুটে থাকে।
জল হাসে, জলতার চুড়িপরা হাতে,
নর্তকীর মত নেচে ঘুরে ঘুরে ঘাগরার ছোবলে
সবকিছু কেড়ে নেয়, কেড়ে নিয়ে ফের ভরে দেয়
বাসি-হয়ে-যাওয়া বুকে পদ্মগন্ধ, প্রকাণ্ড উদ্যান।
এই অপরূপ ধ্বংস, মরচে-পড়া ঘরের-দোরে চাঁপা রঙে এই চুনকাম
দরবারী কানাড়া এরই নাম ?
সরোদ বাজাতে জানলে বড় ভাল হতো।
পুরুষ কীভাবে বাঁচে সে-ই শুধু জানে।
...

কথোপকথন-১১ / পূর্ণেন্দু পত্রী

...
--তুমি আজকাল বড় সিগারেট খাচ্ছ শুভঙ্কর।
--এখনি ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছি।
কিন্তু তার বদলে ?
--বড্ড হ্যাংলা। যেন খাওনি কখনো ?
--খেয়েছি।
লোকে বলেছিল ভানুমতীর খেল দেখালে
আপনারা নাকি সোনার মেডেল দেন।
নিজের করাতে নিজেকে দুখান করে
আবার জুড়ে দেখালুম,
আকাশ থেকে সোনালি পাখির ডিম পেড়ে
আপনাদের ভেজে খাওয়ালুম গরম ওমলেট,
বাঁজা গাছে বাজিয়ে দিলুম ফুলের ঘুঙুর।
সোনার ম্যাডেল দিবেন না ?
বাবুমশাইরা,
সেই ল্যাংটোবেলা থেকে বড় শখ
ঘরে ফিরবো বুকে সোনার ম্যাডেল টাঙিয়ে।
আর বৌ-বাচ্চাদের মুখে
ফাটা কার্পাসতুলোর হাসি ফুটিয়ে বলবো-
দেখিস ! আমি মারা গেলে
আমার গা থেকে গজাবে
চন্দন-গন্ধের বন।
সোনার ম্যাডেল দিবেন নি ?
...

Friday, May 21, 2010

প্রেম / দাউদ হায়দার

...
প্রেম দ্যাখো বয়স মানেনা কোনদিন
ছোটবড় তালার মতো সব বয়সের কপাটে ঝুলে পড়ে হঠাৎ

প্রেম, সবুজ নিসর্গ থেকে পলাতক কয়েদীর মতোন নিঃশব্দে বেরিয়ে
                           আসে দ্রুত
ঠাঁই নেয় বিভিন্ন লোকালয়ে; খেলা করে সকাল বিকাল
তোলপাড়ে ভেঙে যায় নীলিমার আজীবন আশীর্বাদ-গড়ে তোলে
                           সুখ-দুঃখ
             পড়ে থাকে বয়স্কদের দারুণ চোখ

প্রেম, সেতো বয়স মানে নি কোনদিন- বুঝি তাই
তীক্ষ্ণ চকচকে সোনার ছুরি এনে বসিয়ে দেয় সকল প্রহরে
মেতে ওঠে ভয়াবহ বন্যার জলের মতো বাদশাহী হৃদয়ে-এবং
                           ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় পারিবারিক স্নেহ-মমতা
অথচ শুধু বেঁচে থাকে পরস্পর হৃদয়ের সুন্দর দৃশ্যাবলী !

আমার ডুগডুগি / তারাপদ রায়

...
আমি মমতা থেকে তুলে এনেছিলাম পরিহাস
আমি বিষাদ থেকে তুলে এনেছিলাম অশ্রু
আমি ঘুম থেকে তুলে এনেছিলাম স্বপ্ন
আমি স্মৃতি থেকে তুলে এনেছিলাম অভিমান
আমি শব্দ থেকে তুলে এনেছিলাম কবিতা
            তুমি কোনোদিন কিছুই খেয়াল করোনি

আমি বিষাদসিন্ধুর তীরে দাঁড়িয়ে ডুগডুগি বাজিয়েছিলাম
তুমি সেই বাঁদরনাচের বাজনা শুনতে পাওনি।
উত্তরের অনন্ত বাতাসে ঝরা পাতার মতো উড়ে উড়ে পড়েছে

আমার পরিহাসময় অশ্রু, আমার স্বপ্নময় অভিমান।

জ্যোৎস্নায় তুমি কথা বলছো না কেন / আবুল হাসান

...
প্রতিটি নতুন কথা বলাটাই হলো আমাদের প্রেম,
প্রতিটি নতুন শব্দই হলো শিল্পকলার সীমাঃ
              হে অসীমা তুমি কথা বলছো না কেন ?
ওষ্ঠে কাঁপন ধরানোই হলো
              নিবিড় নিহিত আবেগের চুম্বন।
এসো তবে ঠোঁটে কাঁপন ধরাই
দু'জনের ঠোঁটে দূরের কুজন, হাওয়া শনশন্ চুম্বন গড়ে তুলি।
একাকী থেকেও এখন আমরা এসো দু'জনের মুগ্ধতা আনি মুখে
কপালে কাঁপাই ভ্রূযুগল অনুভূতি।
বাতাসে বহাই চক্ষুর সম্মতি।
এসো সতী মেয়ে আবার আমরা শুয়ে পড়ি, সেতু বাঁধি
              দুই শরীরের মিলনে ঐকতান,
সংরাগে দেই সুন্দর করতালিঃ
আমাদের দুটি হৃদয়ে আজকে প্রথম ধরেছে কলি,
এসো উদ্যানে পুষ্প পবনে অঙ্গার হয়ে জ্বলি।
সূর্যে তারায় শত শনশন সবুজ ডেরায় আমি তুলি ঝঙ্কার
              কান পেতে তুমি তাই শোনো মৃত্তিকা,
এসো সুন্দর, এসো হে শহরতলী,
আমাকে বানাও ঘন সবুজের শিখা,
              তুমি তো বনস্থলী,
তোমাকে কে চেনে আর
আমি ছাড়া আর কে জানে তোমার কেন এ অহঙ্কার,
কেন নিশ্চুপ, কথা বলছো না হৃদয়ে পূর্ণিমার
জ্যোৎস্নায় তুমি কথা বলছো না কেন।
...

সব রৌদ্র ফিরে যায় না / আবুল হাসান

...
সব রৌদ্র ফিরে যায় না, লুকিয়ে থাকে
            রাতের ফাঁকে যেমন তুমি।
কোথায় ছিলে ? কোন্ পাহাড় কোন্ পোস্টাফিসে
            চিঠির মতো
ভোরের মতো কোন্ জানালায় তাকিয়ে ছিলে
            চোখের ছায়ায় ?
সব রৌদ্র ফিরে যায় না লুকিয়ে থাকে
            পথের পাশে
কাঁচের মতন গোল গেলাসে
            জলের ছায়ায়
ফিরে আসে, যেমন তুমি ফিরে এলে।
...

হে উর্বর শরীর মাংসাশী / আবুল হাসান

...
তোমার বাঁশির ফুঁয়ে পরান্মুখ: গন্ধহীন পরস্পরে যাই
পিছনে আমার পড়ে থাক নিবাস অতল বৃক্ষ মহামতী
সারি সারি বিনাশী বান্ধব, যাই মাছের সবুজ নীড় ছেড়ে
যতদূর পারি, নীল স্নায়ুর ভেতর শো' শো' তরল জাহাজে চ'ড়ে
হে শরীর, সৃজন অনাদি।

এবার বিদায় তবে বিপরীতে, অভিভূত চাষা, শুধু আমার সত্তা, স্বপ্ন
গন্ধের বিভায় থাক নারী পুরুষের মতো অরণ্যে শুয়ে এই উপদ্রবহীনে,
              অক্ষত !
বিদায় নেবোই, তবু সাঁঝবেলা, হে উর্বর শরীর মাংসাশী
জীর্ণানী আমাকে আর কতোকাল মৎসে ভুলাবে ?
...

খিড়কি / আবিদ আজাদ

...
খিড়কি ছিলো পাশের বাড়ির
খিড়কি ছলো মনের
খিড়কি ছিলো যখন তখন
খিড়কি কিছুক্ষণের।

খিড়কি ছিলো পথের পাশে
হলুদ গাঁদাফুলের
খিড়কি ছিলো আকাশ ভরা
মেঘের কালোচুলের।

খিড়কি ছিলো তোমার মনে
যখন খুশি খোলার
খিড়কি ছিলো সময়মতো
আমার কথা ভোলার।

যদি / অঞ্জনা সাহা

...
তুমি চাইলেই সব কিছু হয়,
ভুলতে পারি শোক।
দিতেই পারো আমার দিকে
একটু মনোযোগ।
আমার মতো তুমিও তবে
বাসতে পারো ভালো
জ্বালতে পারি দুই চোখেতে
ভালোবাসার আলো।
তুমি চাইলে হতে পারি
এক নিমেষেই নদী
সাহস করে সেই নদীতে
নামতে পারো যদি।
...

রানার / সুকান্ত ভট্টাচার্য

...
রানার ছুটেছে তাই ঝুম ঝুম ঘণ্টা বাজছে রাতে
রানার চলেছে খবরের বোঝা হাতে,
রানার চলেছে, রানার !
রাত্রির পথে পথে চলে কোনো নিষেধ জানে না মানার।
দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছোটে রানার-
কাজ নিয়েছে সে নতুন খবর আনার।

রানার ! রানার !
জানা-অজানার
বোঝা আজ তার কাঁধে,
বোঝাই জাহাজ চলেছে চিঠি আর সংবাদে;
রানার চলেছে, বুঝি ভোর হয় হয়,
আরো জোরে, আরো জোরে, এ রানার দূর্বার দূর্জয়।
তার জীবনের স্বপ্নের মত পিছে সরে যায় বন,
আরো পথ, আরো পথ-বুঝি হয় লাল ও পূর্ব কোণ।
অবাক রাতের তারারা আকাশে মিটমিট করে চায়;
কেমন ক'রে এ রানার সবেগে হরিণের ম ধায় !
কত গ্রাম, কত পথ যায় স'রে স'রে
শহরে রানার যাবেই পৌঁছে ভোরে;
হাতে লণ্ঠন করে ঠনঠন্ জোনাকিরা দেয় আলো
মাভৈঃ রানার ! এখনো রাতের কালো।

ফুল ফুটুক না ফুটুক / সুভাষ মুখোপাধ্যায়

...
ফুল ফুটুক না ফুটুক
আজ বসন্ত।

শান-বাঁধানো ফুটপাথে
পাথরে পা ডুবিয়ে এক কাঠখোট্টা গাছ
কচি কচি পাতায় পাঁজর ফাটিয়ে
হাসছে।

ফুল ফুটুক না ফুটুক
আজ বসন্ত।
আলোর চোখে কালো ঠুলি পরিয়ে
তারপর খুলে-
মৃত্যুর কোলে মানুষকে শুইয়ে দিয়ে
তারপর তুলে-
যে দিনগুলো রাস্তা দিয়ে চলে গেছে
যেন না ফেরে।
গায়ে হলুদ দেওয়া বিকেলে
একটা দুটো পয়সা পেলে
যে হরবোলা ছেলেটা
কোকিল ডাকতে ডাকতে যেত
-তাকে ডেকে নিয়ে গেছে দিনগুলো।

বাঙলা ছাড়ো / সিকানদার আবু জাফর

...
রক্তচোখের আগুন মেঘে ঝলসে যাওয়া
আমার বছরগুলো
আজকে যখন হাতের মুঠোয়
কণ্ঠনালীর খুনপিয়াসী ছুরি,
কাজ কী তবে আগলে রেখে বুকের কাছে
কেউটে সাপের ঝাঁপি !
আমার হাতেই নিলাম আমার
নির্ভরতার চাবি;
তুমি আমার আকাশ থেকে
সরাও তোমার ছায়া,
তুমি বাঙলা ছাড়ো।

এসো, আমরা প্রেমের গান গাই / বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

...
রাজা দেখলাম, রানী দেখলাম
এবার একটু মানুষের কাছে বসতে চাই।

এসো আমরা প্রেমের গান গাই।

এসো, আমাদের প্রিয় কবির কাছে যাই,
তাকে বলি:
আপনি গাছ ফুল পাখি ভালবাসেন
আপনি মানুষ ভালবাসেন-

'প্রেমের গান গাইতে আমাদের গলা কেঁপে যায়;
আপনি আমাদের গান শেখান!'

রাজা দেখলাম, রানী দেখলাম
এবার আমরা আমাদের প্রিয় কবির কাছে ফিরে যাবো।
তিনি আমাদের সেই গান শেখাবেন
যা তুমি আর আমি গাইতে চাই।

এইসব ছাইপাশ কবিতা আর ভাল লাগে না।
আর ভাল লাগে না ওদের মুখের ওপর
ঘৃণার কবিতা ছুঁড়ে দিতে।

এ কোনো মানুষের জীবন নয়, কবির জীবন নয়।

এক সেকেণ্ডে মাত্র চারফুট / রবিউল হুসাইন

...
মানুষেরা নাকি এক সেকেণ্ডে চার ফুট হাঁটতে পারে সাধারণত

বারো কোটি মানুষ আমরা।
আমরা সবাই এক সঙ্গে হাঁটলে মোট আটচল্লিশ কোটি ফুট
অর্থাৎ ষোল কোটি গজ, তার মানে
এক সেকেণ্ডে প্রায় নব্বই হাজার নয়শ' দশ মাইল
এগিয়ে যেতে পারি

স্বাধীনতা পাওয়ার পর বিশ বছর পার হয়ে গেছে
অথচ আমরা একই জায়গায় একই বিন্দুতে
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দৌড়িয়ে মরছি সব সময়
এক ইঞ্চিও অগ্রসর হতে পারছি না

মাতৃভাষা / মুহম্মদ নূরুল হুদা

...
মানুষেরা নদী নয়, মানুষের বুকে তবু নদীর পিপাসা

গাঙেয় পিপাসা নিয়ে বায়ান্নোর যে যুব-শোণিত
দ্রাবিড় ব-দ্বীপ জুড়ে হয়ে গেলো মানবিক নদী
তাদের পলিতে দেখো গড়ে ওঠে অনার্য স্বদেশ
অনন্ত ঝর্ণার মতো বুকে তার সবুজ মানুষ;

নদীর শব্দের সাথে জেগে থাকে মানুষের প্রিয় মাতৃভাষা
                 মাতৃভাষা, মাতৃভাষা।।
...

আমি জেলে যাবার পর / নাজিম হিকমত

...
জেলে এলাম সেই কবে
তারপর দশবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করেছে পৃথিবী
পৃথিবীকে যদি বলো, সে বলবে-
"কিছুই নয়,
অণুমাত্র কাল।"
আমি ব'লব-
"আমার জীবনের দশটা বছর।"

যে বছর জেল এলাম
একটা পেন্সিল পেলাম
লিখে লিখে ক্ষইয়ে ফেলাতে এক হপ্তাও লাগে নি।
পেন্সিলকে জিজ্ঞেস করলে সে বলবে:
"একটা গোটা জীবন।"
আমি ব'লব:
"এমন আর কী, একটা মাত্র সপ্তাহ।"

Thursday, May 20, 2010

একুশের কবিতা / আশরাফ সিদ্দিকী

...
পাখী সব করে রব রাতি পোহাইল
কাননে কুসুম কলি সকলি ফুটিল।

কবেকার পাঠশালায় পড়া মন্ত্রের মতো সেই সুর
সুর নয় স্মৃতির মধুভাণ্ডার............
সেই আমার দেশ মাঠ বন নদী
আমার দেশের জারি সারি ভাটিয়ালি মুর্শিদি
আরও কত সুরের সাথে মিশে আছে
আমার মায়ের মুখ
আমার মায়ের গাওয়া কত না গানের কলি !
বিন্নী ধানের মাঠের ধারে হঠাৎ কয়েকটি গুলির আওয়াজ.......
কয়েকটি পাখির গান শেষ না হতেই তারা ঝরে গেল
            পড়ে গেল মাটিতে।

সেই শোকে কালবৈশাখীর ঝড় উঠলো আকাশে
মাঠ কাঁপালো
ঘাট কাঁপালো
বাট কাঁপালো
হাট কাঁপালো
বন কাঁপালো
সন কাঁপালো
ইতিহাস থমকে দাঁড়িয়ে লিখে নিলো সব................
তাই তো সহস্র পাখির কলতানে আজ দিগন্ত মুখর
তাই তো আজ দ্যাখো এ মিছিলে এসে দাঁড়িয়েছেন আমার মা
যিনি বাংলাভাষায় কথা বলা বড় ভালোবাসেন
কথায় কথায় কথকতা কতো রূপকথা
আর ছড়ার ছন্দে মিষ্টি সুরের ফুল ছড়ান
তিনি এখনো এ মিছিলে গুনগুন করে গাইতে পারেন:
            পাখী সব করে রব রাতি পোহাইল।
            কাননে কুমুম কলি সকলি ফুটিল।।
            রাখাল গরুর পাল লয়ে যায় মাঠে।
            শিশুগণ দেয় মন নিজ নিজ পাঠে।।
...

আমি মেঘনা পাড়ের ছেলে / আহসান হাবীব

...
আমি মেঘনা পাড়ের ছেলে
আমি মেঘনা নদীর নেয়ে।
মেঘনা নদীর ঢেউয়ের বুকে
তালের নৌকা বেয়ে
আমি বেড়াই হেসে খেলে
আমি মেঘনা পাড়ের ছেলে।
মেঘনা নদীর নেয়ে আমি মেঘনা পাড়ে বাড়ি
ইচ্ছে হলেই এপার থেকে ওপারে দেই পাড়ি
তালে তালে তালের নৌকো
দু'হাতে যাই বেয়ে
আমি মেঘনা নদীর নেয়ে।

পাহাড় সমান ঢেউয়ের বুকে নৌকা আমার ভাসে
মেঘমুলুকের পাহাড় থেকে ঝড়ের ঝাপটা আসে
মাথার ওপর মুচকি হাসে
বিজলী নামের মেয়ে
আমি মেঘনা নদীর নেয়ে।

আমার ঢেউয়ের সঙ্গে গলাগলি ঢেউয়ের সঙ্গে খেলা
ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করে কাটাই সারাবেলা
দেশ থেকে যাই দেশান্তরে
মনের নৌকো বেয়ে
আমি মেঘনা নদীর ছেলে
আমি মেঘনা নদীর নেয়ে।
,,,

Wednesday, May 19, 2010

ছবি / আবু হেনা মোস্তফা কামাল

...
আপনাদের সবার জন্যে এই উদার আমন্ত্রণ
ছবির মতো এই দেশে একবার বেড়িয়ে যান।
অবশ্য উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো মনোহারী স্পট আমাদের নেই,
কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না- আপনার স্ফীত সঞ্চয় থেকে
উপচে পড়া ডলার মার্ক কিংবা স্টার্লিঙের বিনিময়ে যা পাবেন
ডাল্লাস অথবা মেম্ফিস অথবা কালিফোর্নিয়া তার তুলনায় শিশুতোষ !

আসুন, ছবির মতো এই দেশে বেড়িয়ে যান
রঙের এমন ব্যবহার, বিষয়ের এমন তীব্রতা
আপনি কোনো শিল্পীর কাজে পাবেন না, বস্তুত শিল্প মানেই নকল নয় কি ?
অথচ দেখুন, এই বিশাল ছবির জন্যে ব্যবহৃত সব উপকরণ অকৃত্রিম;
আপনাকে আরো খুলে বলি: এটা, অর্থাৎ আমাদের এই দেশ,
এবং আমি যার পর্যটন দপ্তরের অন্যতম প্রধান, আপনাদের খুলেই বলি,
সম্পূর্ণ নতুন একটি ছবির মতো করে
             সম্প্রতি সাজানো হয়েছে।

খাঁটি আর্যবংশদ্ভূত শিল্পীর কঠোর তত্ত্বাবধানে ত্রিশ লক্ষ কারিগর
দীর্ঘ নটি মাস দিনরাত পরিশ্রম করে বানিয়েছেন এই ছবি।
এখনো অনেক জায়গায় রং কাঁচা- কিন্তু কী আশ্চর্য গাঢ় দেখেছেন ?
ভ্যান গগ্-যিনি আকাশ থেকে নীল আর শস্য থেকে
             সোনালি তুলে এনে
ব্যবহার করতেন- কখনো, শপথ করে বলতে পারি,
             এমন গাঢ়তা দেখেন নি !

আর দেখুন, এই যে নরমুণ্ডের ক্রমাগত ব্যবহার- ওর ভেতরেও
একটা গভীর সাজেশান আছে- আসলে ওটাই এই ছবির-অর্থাৎ
এই ছবির মতো দেশের- থিম্ !
...

শহীদদের প্রতি / আসাদ চৌধুরী

...
তোমাদের যা বলার ছিল
বলছে কি তা বাংলাদেশ ?
শেষ কথাটি সুখের ছিল ?
ঘৃণার ছিল ?
নাকি ক্রোধের,
প্রতিশোধের,
কোনটা ছিল ?
নাকি কোনো সুখের
নাকি মনে তৃপ্তি ছিল
এই যাওয়াটাই সুখের।
তোমরা গেলে, বাতাস যেমন যায়
গভীর নদী যেমন বাঁকা
স্রোতটিকে লুকায়
যেমন পাখির ডানার ঝলক
গগনে মিলায়।
সাঁঝে যখন কোকিল ডাকে
কারনিসে কি ধুসর শাখে
বারুদেরই গন্ধস্মৃতি
ভুবন ফেলে ছেয়ে
ফুলের গন্ধ পরাজিত
স্লোগান আসে ধেয়ে।
তোমার যা বলার ছিল
বলছে কি তা বাংলাদেশ ?
...

তখন সত্যি মানুষ ছিলাম / আসাদ চৌধুরী

...
নদীর জলে আগুন ছিল
আগুন ছিল বৃষ্টিতে
আগুন ছিল বীরাঙ্গনার
উদাস করা দৃষ্টিতে।
আগুন ছিল গানের সুরে
আগুন ছিল কাব্যে,
মরার চোখে আগুন ছিল
এ কথা কে ভাববে ?
কুকুর-বেড়াল থাবা হাঁকায়
ফোঁসে সাপের ফণা
শিং কৈ মাছ রুখে দাঁড়ায়
জ্বলে বালির কণা।
আগুন ছিল মুক্তিসেনার
স্বপ্ন-ঢলের বন্যায়-
প্রতিবাদের প্রবল ঝড়ে
কাঁপছিল সব অন্যায়।
এখন এসব স্বপ্নকথা
দূরের শোনা গল্প,
তখন সত্যি মানুষ ছিলাম
এখন আছি অল্প।
...

নিমন্ত্রণ / জসীম উদদীন

...
তুমি যাবে ভাই--যাবে মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়,
গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়;
             মায়া মমতায় জড়াজড়ি করি
             মোর গেহখানি রহিয়াছে ভরি,
মায়ের বুকেতে, বোনের আদরে, ভায়ের স্নেহের ছায়,
তুমি যাবে ভাই--যাবে মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়।

ছোট গাঁওখানি--ছোট নদী চলে, তারি একপাশ দিয়া,
কালো জল তার মাজিয়াছে কেবা কাকের চক্ষু নিয়া।
             ঘাটের কিনারে আছে বাঁধা তরী,
             পারের খবর টানাটানি করি--
বিনাসূতি মালা গাঁথিছে নিতুই এপার ওপার দিয়া;
বাঁকা ফাঁদ পেতে টানিয়া আনিছে দুইটি তটের হিয়া।

আমার বাড়ি / জসীম উদদীন

...
আমার বাড়ি যাইও ভোমর,
                   বসতে দেব পিঁড়ে,
জলপান যে করতে দেব
                   শালি ধানের চিঁড়ে।
শালি ধানের চিঁড়ে দেব,
                   বিন্নি ধানের খই,
বাড়ির গাছের কবরী কলা
                   গামছা বাঁধা দই।
আমা-কাঁঠালের বনের ধারে
                   শুয়ো আঁচল পাতি,
গাছের শাখা দুলিয়ে বাতাস
                   করব সারা রাতি।
চাঁদমুখে তোর চাঁদের চুমো
                   মাখিয়ে দেব সুখে,
তারা-ফুলের মালা গাঁথি
                   জড়িয়ে দেব বুকে।
গাই দোহনের শব্দ শুনি
                   জেগো সকাল বেলা,
সারাটা দিন তোমায় লয়ে
                   করব আমি খেলা।
আমার বাড়ি ডালিম গাছে
                   ডালিম ফুলের হাসি,
কাজলা দিঘির কাজল জলে
                   হাঁসগুলি যায় ভাসি।
আমার বাড়ি যাইও ভোমর,
                   এই বরাবর পথ,
মৌরি-ফুলের গন্ধ শুঁকে
                   থামিও তব রথ।
...

হবুচন্দ্রের আইন / সুনির্মল বসু

...
হবুচন্দ্র রাজা বলেন গবুচন্দ্রে ডেকে--
"আইন জারী করে দিও রাজ্যেতে আজ থেকে,
                       মোর রাজ্যের ভিতর--
হোক্ না ধনী, হোক্ না গরীব, ভদ্র কিংবা ইতর,
কাঁদতে কেহ পারবে নাক, যতই মরুক শোকে--
হাসবে আমার যতেক প্রজা, হাসবে যত লোকে।
সান্ত্রী-সেপাই, প্যায়দা, পাইক ঘুরবে ছদ্মবেশে,
কাঁদলে কেহ, আনবে বেঁধে, শাস্তি হবে শেষে।"
                       বলে গবু- "হুজুর--
ভয় যদি কেউ পায় কখনো দৈত্য, দানা জুজুর,
কিম্বা যদি পিছলে পড়ে মুণ্ডু ফাটায় কেহ,
গাড়ীর তলে কারুর যদি থেঁতলিয়ে যায় দেহ;
কিম্বা যদি কোনো প্রজার কান দুটি যায় কাটা,
কিম্বা যদি পড়ে কারুর পিঠের ওপর ঝাঁটা;
সত্যিকারের বিপন্ন হয় যদি,
তবুও কি সবাই তারা হাসবে নিরবধি ?"
                      রাজা বলেন- "গবু-
আমার আইন সকল প্রজার মানতে হবে তবু।
কেউ যদি হয় খুন বা জখম, হাড্ডিতে ঘুণ ধরে,
পাঁজরা যদি ঝাঁঝরা হয়ে মজ্জা ঝরে পড়ে,
ঠ্যাংটি ভাঙে, হাতটি কাটে, ভুঁড়িটি যায় ফেঁসে,
অন্ধকারে স্কন্ধ কাটা ঘাড়টি ধরে ঠেসে,
কিম্বা যদি ধড়ের থেকে মুণ্ডুটি যায় উড়ে,
কাঁদতে কেহ পারবে নাক বিশ্রী বিকট সুরে।
                     হবুচন্দ্রের দেশে--
মরতে যদি হয় কখনো, মরতে হবে হেসে।"

Tuesday, May 18, 2010

সাহেব ও মোসাহেব / কাজী নজরুল ইসলাম

...
সাহেব কহেন,  "চমৎকার ! সে চমৎকার !"
মোসাহেব বলে,  "চমৎকার সে হতেই হবে যে !
                     হুজুরের মতে অমত কার ?"
সাহেব কহেন,  "কী চমৎকার,
                   বলতেই দাও, আহা হা।"
মোসাহেব বলে, "হুজুরের কথা
                    শুনেই বুঝেছি, বাহাহা বাহাহা বাহাহা !"
সাহেব কহেন,   "কথাটা কি জান ? সেদিন-- ?
                    মোসাহেব বলে, "জানি না আবার ?
                    ঐ যে, কি বলে, যেদিন--"
সাহেব কহেন,   "যেদিন বিকেলে বৃষ্টিটা ছিল স্বল্প।"
মোসাহেব বলে, "আহা হা, শুনেছ ?
                    কিবা অপরূপ গল্প !"

লিচু-চোর / কাজী নজরুল ইসলাম

...
বাবুদের তাল-পুকুরে
হাবুদের ডাল-কুকুরে
সে কি বাস্ করলে তাড়া,
বলি থাম্ একটু দাঁড়া।
পুকুরের ঐ কাছে না
লিচুর এক গাছ আছে না
হোথা না আস্তে গিয়ে
য়্যাব্বড় কাস্তে নিয়ে
গাছে গ্যে যেই চড়েছি
ছোট এক ডাল ধরেছি,
ও বাবা, মড়াৎ করে
পড়েছি সড়াৎ জোরে !
পড়বি পড় মালীর ঘাড়েই,
সে ছিল গাছের আড়েই।

নিঃস্বার্থ / সুকুমার রায়

...
গোপালটা কি হিংশুটে মা ! খাবার দিলাম ভাগ করে,
বল্লে নাকো মুখেও কিছু, ফেল্লে ছুঁড়ে রাগ করে।
জ্যেঠাইমা যে মেঠাই দিলেন, 'দুই ভায়েতে খাও বলে'--
দশটি ছিলো, একটি তাহার চাখতে দিলেম ফাও বলে,
আর যে নটি, ভাগ করে তায় তিনটে দিলেম গোপালকে--
তবুও কেবল হ্যাংলা ছেলে আমার ভাগেই চোখ রাখে।
বুঝিয়ে বলি, কাঁদিস কেন ? তুই যে নেহাৎ কনিষ্ঠ,
বয়স বুঝে, সামলে খাবি, তা নইলে হয় অনিষ্ট।
তিনটি বছর তফাৎ মোদের, জ্যায়দা হিসাব গুণতি তাই,
মোদ্দা আমার ছয় খানি হয়, তিন বছরে তিনটি পাই,
তাও মানে না কেবল কাঁদে, স্বার্থপরের শয়তানি,
শেষটা আমার মেঠাইগুলো খেতেই হলো সবাখানি।
...

ঠিকানা / সুকুমার রায়

...
আরে আরে জগমোহন--এস, এস, এস--
বলতে পার কোথায় থাকে আদ্যানাথের মেসো ?
আদ্যানাথের নাম শোন নি ? খগেনকে তো চেনো ?
শ্যাম বাগচি খগেনেরই মামাশ্বশুর জেনো।
শ্যামের জামাই কেষ্টমোহন, তার যে বাড়িওলা--
(কি যেন নাম ভুলে গেছি), তারই মামার শালা;
তারই পিসের খুড়তুতো ভাই আদ্যানাথের মেসো,
লক্ষ্মী দাদা, ঠিকানা তার একটু জেনে এসো।

ঠিকানা চাও ? বলছি শোন; আমড়াতলার মোড়ে,
তিন-মুখো তিন রাস্তা গেছে, তারি একটা ধ'রে
চলবে সিধে নাকবরাবর, ডানদিকে চোখ রেখে,
চলতে চলতে দেখবে শেষে রাস্তা গেছে বেঁকে।
দেখবে সেথায় ডাইনে বাঁয়ে রাস্তা গেছে কত,
তারি ভিতর ঘুরবে খানিক গোলকধাঁধার মতো।
তার পরেতে হঠাৎ বেঁকে ডাইনে মোচড় মেরে,
ফিরবে আবার বাঁয়ের দিকে তিনটে গলি ছেড়ে।
তবেই আবার পড়বে এসে আমড়াতলার মোড়ে,
তার পরে যাও যেথায় খুশি, জ্বালিয়ো নাকো মোরে।
...

Monday, May 17, 2010

পাকাপাকি / সুকুমার রায়

...
আম পাকে বৈশাখে কুল পাকে ফাগুনে,
কাঁচা ইট পাকা হয় পোড়ালে তা আগুনে।
রোদে জলে টিকে রঙ, পাকা কই তাহারে,
ফলারটি পাকা হয় লুচি দই আহারে।
হাত পাকে লিখে লিখে, চুল পাকে বয়সে
জ্যাঠামোতে পাকা ছেলে বেশি কথা কয় সে।
লোকে কয় কাঁঠাল সে পাকে নাকি কিলিয়ে ?
বুদ্ধি পাকিয়ে তোলে লেখাপড়া গিলিয়ে !
কান পাকে ফোড়া পাকে, পেকে করে টনটন--
কথা যার পাকা নয়, কাজে তার ঠনঠন্।
রাধুনি বসিয়া পাকে, পাক দেয় হাঁড়িতে,
সজোরে পাকালে চোখ ছেলে কাঁদে বাড়িতে।
পাকায়ে পাকায়ে দড়ি টান হয়ে থাকে সে,
দুহাতে পাকালে গোঁফ তবু নাহি পাকে সে।
...

স্বর্গ ও নরক / শেখ ফজলুল করিম

...
কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর ?
মানুষেরি মাঝে স্বর্গ নরক, --মানুষেতে সুরাসুর !
রিপুর তাড়নে যখনি মোদের বিবেক পায় গো লয়,
আত্মগ্লানির নরক-অনলে তখনি পুড়িতে হয়।
প্রীতি ও প্রেমের পুণ্য বাঁধনে যবে মিলি পরস্পরে,
স্বর্গ আসিয়া দাঁড়ায় তখন আমাদেরি কুঁড়ে ঘরে।
...

কোন দেশে / সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত

...
কোন্ দেশেতে তরুলতা
        সকল দেশের চাইতে শ্যামল ?
কোন্ দেশেতে চলতে গেলেই
        দলতে হয় রে দূর্বা কোমল ?
কোথায় ফলে সোনার ফসল,
        সোনার কমল ফোটে রে ?
সে আমাদের বাংলাদেশ,
        আমাদেরই বাংলা রে !

কোথায় ডাকে দোয়েল-শ্যামা
        ফিঙে নাচে গাছে গাছে ?
কোথায় জলে মরাল চলে,
        মরালী তার পাছে পাছে;
বাবুই কোথা বাসা বোনে,
        চাতক বারি যাচে রে ?
সে আমাদের বাংলাদেশ
        আমাদেরই বাংলা রে !
...

অধম ও উত্তম / সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত

...
কুকুর আসিয়া এমন কামড়
           দিল পথিকের পায়
কামড়ের চোটে বিষদাঁত ফুটে
           বিষ লেগে গেল তায়।

ঘরে ফিরে এসে রাত্রে বেচারা
           বিষম ব্যথায় জাগে,
মেয়েটি তাহার তারি সাথে হায়
           জাগে শিয়রের আগে।

বাপেরে সে বলে ভর্ৎসনা-ছলে
           কপালে রাখিয়া হাত,
"তুমি কেন বাবা, ছেড়ে দিলে তারে
           তোমার কি নেই দাঁত !"

মানুষ জাতি / সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত

...
জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে
            সে জাতির নাম মানুষ জাতি;
এক পৃথিবীর স্তন্যে লালিত
            একই রবি শশী মোদের সাথী।
শীতাতপ ক্ষুধা তৃষ্ণার জ্বালা
            সবাই আমরা সমান বুঝি,
কচি কাঁচাগুলি ডাঁটো করে তুলি
            বাঁচিবার তরে সমান যুঝি।
দোসর খুঁজি ও বাসর বাঁধি গো,
            জলে ডুবি, বাঁচি পাইলে ডাঙ্গা,
কালো আর ধলো বাহিরে কেবল
            ভিতরে সবারই সমান রাঙা।
বাহিরের ছোপ আঁচড়ে সে লোপ
            ভিতরের রং পলকে ফোটে,
বামুন, শূদ্র, বৃহৎ, ক্ষুদ্র
            কৃত্রিম ভেদ ধুলায় লোটে।...

চাঁদ / বেগম রোকেয়া

...
নিষ্ঠুর নিদয় শশী             সুদূর গগনে বসি,
কি দেখিছ ? জগতের হিংসা পাপরাশি ?
মোরে দেখে পায় তব হাসি ?

যখন তাপিত প্রাণে           চাহি তব মুখ পানে,
তোমার এ হাসি দেখে হিংসা হয় চিতে।
-আমি কেন পারি না হাসিতে ?

জগতের দুঃখ-ভয়           তোমাদের সঙ্গী নয়,
পাপ-তাপ তোমাদের কাছে নাহি যায়
-তারা কেন আমারে কাঁদায় ?

তুমি নীলিমার দেশে         যথা ইচ্ছা যাও ভেসে,
অনন্ত আকাশে যেন তোমারি আলয় !
-আমি কেন পাই না আশ্রয় ?
...

মোদের গরব, মোদের আশা / অতুলপ্রসাদ সেন

...
মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা !
তোমার কোলে, তোমার বোলে, কতই শান্তি ভালবাসা !
কি যাদু বাংলা গানে ! -গান গেয়ে দাঁড় মাঝি টানে,
                      এমন কোথা আর আছে গো !
গেয়ে গান নাচে বাউল, গান গেয়ে ধান কাটে চাষা।।
এই ভাষাতেই নিতাই গোরা, আনল দেশে ভক্তি-ধারা,
                      মরি হায়, হায় রে !
আছে কই এমন ভাষা, এমন দুঃখ-শ্রান্তি-নাশা !
বিদ্যাপতি, চণ্ডী, গোবিন, হেম, মধু, বঙ্কিম, নবীন-
                      আরো কত মধুপ গো !
ঐ ফুলেরি মধুর রসে, বাঁধলো সুখে মধুর বাসা।।
বাজিয়ে রবি তোমার বীণে, আনলো মালা জগৎ জিনে-
                      গরব কোথায় রাখি গো !
তোমার চরণ-তীর্থে আজি, জগৎ করে যাওয়া-আসা।
ওই ভাষাতেই প্রথম বোলে, ডাকনু মায়ে 'মা', 'মা' বলে;
ওই ভাষাতেই বলবো 'হরি', সাঙ্গ হলে কাঁদা-হাসা।।
...

হারাধনের দশটি ছেলে ১ / যোগীন্দ্রনাথ সরকার

...
হারাধনের দশটি ছেলে
          ঘোরে পাড়াময়,
একটি কোথা হারিয়ে গেল
          রইল বাকি নয়।

হারাধনের নয়টি ছেলে
          কাটতে গেল কাঠ,
একটি কেটে দু'খান হল
          রইল বাকি আট।

হারাধনের আটটি ছেলে
          বসলো খেতে ভাত,
একটির পেট ফেটে গেল
          রইল বাকি সাত।

মজার দেশ / যোগীন্দ্রনাথ সরকার

...
এক যে আছে মজার দেশ, সব রকমে ভালো,
রাত্তিরেতে বেজায় রোদ, দিনে চাঁদের আলো !
       আকাশ সেথা সবুজবরণ গাছের পাতা নীল;
       ডাঙ্গায় চরে রুই কাতলা জলের মাঝে চিল !
সেই দেশেতে বেড়াল পালায়, নেংটি-ইঁদুর দেখে;
ছেলেরা খায় 'ক্যাস্টর-অয়েল' -রসগোল্লা রেখে !
       মণ্ডা-মিঠাই তেতো সেথা, ওষুধ লাগে ভালো;
       অন্ধকারটা সাদা দেখায়, সাদা জিনিস কালো !
ছেলেরা সব খেলা ফেলে বই নে বসে পড়ে;
মুখে লাগাম দিয়ে ঘোড়া লোকের পিঠে চড়ে !
       ঘুড়ির হাতে বাঁশের লাটাই, উড়তে থাকে ছেলে;
       বড়শি দিয়ে মানুষ গাঁথে, মাছেরা ছিপ্ ফেলে !

বিনয় / রজনীকান্ত সেন

...
বিজ্ঞ দার্শনিক এক আইল নগরে,
ছুটিল নগরবাসী জ্ঞান-লাভ তরে;
সুন্দর-গম্ভীর-মূর্তি, শান্ত-দরশন,
হেরি সবে ভক্তি ভরে বন্দিল চরণ।
সবে কহে, "শুনি, তুমি জ্ঞানী অতিশয়,
দু'একটি তত্ত্ব-কথা কহ মহাশয়।"
দার্শনিক বলে, "ভাই, কেন বল জ্ঞানী ?
'কিছু যে জানি না', আমি এই মাত্র জানি।"
...

পরোপকার / রজনীকান্ত সেন

...
নদী কভু পান নাহি করে নিজ জল,
তরুগণ নাহি খায় নিজ নিজ ফল,
গাভী কভু নাহি করে নিজ দুগ্ধ পান,
কাষ্ঠ, দগ্ধ হয়ে, করে পরে অন্নদান,
স্বর্ণ করে নিজরূপে অপরে শোভিত,
বংশী করে নিজস্বরে অপরে মোহিত,
শস্য জন্মাইয়া, নাহি খায় জলধরে,
সাধুর ঐশ্বর্য শুধু পরহিত-তরে।
...

স্বাধীনতার সুখ / রজনীকান্ত সেন

...
বাবুই পাখিরে ডাকি, বলিছে চড়াই-
"কুঁড়ে ঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই;
আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকা 'পরে,
তুমি কত কষ্ট পাও রোদ, বৃষ্টি, ঝড়ে।"
বাবুই হাসিয়া কহে- "সন্দেহ কি তায় ?
কষ্ট পাই, তবু থাকি নিজের বাসায়;
পাকা হোক, তবু ভাই, পরের ও বাসা,
নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর, খাসা।"
...

পাছে লোকে কিছু বলে / কামিনী রায়

...
করিতে পারি না কাজ
              সদা ভয় সদা লাজ
সংশয়ে সংকল্প সদা টলে,-
              পাছে লোকে কিছু বলে।
আড়ালে আড়ালে থাকি
              নীরবে আপনা ঢাকি,
সম্মুখে চরণ নাহি চলে
              পাছে লোকে কিছু বলে।
হৃদয়ে বুদবুদ মত
              উঠে শুভ্র চিন্তা কত,
মিশে যায় হৃদয়ের তলে,
              পাছে লোকে কিছু বলে।
কাঁদে প্রাণ যবে আঁখি
              সযতনে শুষ্ক রাখি;-
নিরমল নয়নের জলে,
              পাছে লোকে কিছু বলে।
একটি স্নেহের কথা
              প্রশমিতে পারে ব্যথা,-
চলে যাই উপেক্ষার ছলে,
              পাছে লোকে কিছু বলে।

নন্দলাল / দ্বিজেন্দ্রলাল রায়

...
নন্দলাল তো একদা একটা করিল ভীষণ পণ-
স্বদেশের তরে, যা করেই হোক, রাখিবেই সে জীবন।
সকলে বলিল, 'আ-হা-হা কর কি, কর কি, নন্দলাল' ?
নন্দ বলিল, 'বসিয়া বসিয়া রহিব কি চিরকাল ?
আমি না করিলে কে করিবে আর উদ্ধার এই দেশ ?'
তখন সকলে বলিল- 'বাহবা বাহবা বাহবা বেশ !'

নন্দর ভাই কলেরায় মরে, দেখিবে তাহারে কেবা !
সকলে বলিল, 'যাও না নন্দ, করো না ভায়ের সেবা।'
নন্দ বলিল, 'ভায়ের জন্য জীবনটা যদি দিই-
না হয় দিলাম, -কিন্তু অভাগা দেশের হইবে কি ?
বাঁচাটা আমার অতি দরকার, ভেবে দেখি চারি দিক্।'
তখন সকলে বলিল- 'হাঁ হাঁ হাঁ, তা বটে, তা বটে, ঠিক !'

বীরপুরুষ / রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

...
            মনে করো, যেন বিদেশ ঘুরে
            মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে।
তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চ'ড়ে
দরজা দুটো একটুকু ফাঁক ক'রে,
আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ার 'পরে
            টগবগিয়ে তোমার পাশে পাশে।
রাস্তা থেকে ঘোড়ার খুরে খুরে
রাঙা ধুলোয় মেঘ উড়িয়ে আসে।

তালগাছ / রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

...
তালগাছ          এক পায়ে দাঁড়িয়ে
                    সব গাছ ছাড়িয়ে
                         উঁকি মারে আকাশে।
মনে সাধ,        কালো মেঘ ফুঁড়ে যায়
                    একেবারে উড়ে যায়;
                         কোথা পাবে পাখা সে ?
তাই তো সে      ঠিক তার মাথাতে
                    গোল গোল পাতাতে
                    ইচ্ছাটি মেলে তার,-
মনে মনে         ভাবে, বুঝি ডানা এই,
                    উড়ে যেতে মানা নেই
                         বাসাখানি ফেলে তার।

মাস্টারবাবু / রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

...
আমি আজ কানাই মাস্টার,
           পোড়ো মোর বেড়াল ছানাটি।
আমি ওকে মারি নে মা বেত,
           মিছিমিছি বসি নিয়ে কাঠি।
রোজ রোজ দেরি করে আসে,
           পড়াতে দেয় না ও তো মন,
ডান পা তুলিয়ে তোলে হাই
           যত আমি বলি, 'শোন্, শোন্'।
দিনরাত খেলা খেলা খেলা,
           লেখা পড়ায় ভারি অবহেলা।
আমি বলি 'চ ছ জ ঝ ঞ',
ও কেবল বলে 'মিয়োঁ' মিয়োঁ'।

Sunday, May 16, 2010

অঙ্ক-শঙ্কা / নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্য

...
ব'সে ব'সে অঙ্ক ক'ষে পারি নে আর ভাই,
কিছুতে আর অ্যানসারটা মিলছে না যে ছাই।
           যোগ ক'রে মিলল না যখন,
           বিয়োগ ক'রে দেখনু তখন,
একে একে গুণ ভাগও ত ক'রতে ছাড়ি নাই,
কিছুতে যে মিলছে না, তার উপায় কোথা পাই !

অঙ্ক নিয়েই খেটে-খেটে
সারা সকাল গেল কেটে,
ইংরাজিটা কখন করি,
গ্রামারই বা কখন পড়ি,
কখন করি হাইজীন আর জিওগ্রাফিটাই !

কাজের লোক / নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্য

...
       "মৌমাছি, মৌমাছি,
কোথা যাও নাচি' নাচি'
দাঁড়াও না একবার ভাই।"
"ওই ফুল ফুটে বনে,
যাই মধু আহরণে,
দাঁড়াবার সময় তো নাই।"

       "ছোট পাখি, ছোট পাখি,
কিচি-মিচি ডাকি ডাকি'
কোথা যাও, বলে যাও শুনি ?"
       "এখন না ক'ব কথা,
আনিয়াছি তৃণলতা,
আপনার বাসা আগে বুনি।"

       "পিপীলিকা, পিপীলিকা,
দল-বল ছাড়ি একা
কোথা যাও, যাও ভাই বলি।"
       "শীতের সঞ্চয় চাই,
       খাদ্য খুঁজিতেছি তাই,
ছয় পায় পিল্ পিল্ চলি।"
...

পারিব না / কালীপ্রসন্ন ঘোষ

...
'পারিব না' একথাটি বলিও না আর,
কেন পারিবে না তাহা ভাব একবার;
পাঁচজনে পারে যাহা,
তুমিও পারিবে তাহা,
পার কি না পার কর যতন আবার
একবার না পারিলে দেখ শতবার।

পারিবে না বলে মুখ করিও না ভার,
ও কথাটি মুখে যেন না শুনি তোমার।
অলস অবোধ যারা
কিছুই পারে না তারা,
তোমায় তো দেখি নাক তাদের আকার
তবে কেন 'পারিব না' বল বার বার ?

সময় / হরিশচন্দ্র মিত্র

...
খেলায় মজিয়া শিশু কাটায়ো না বেলা
সময়ের প্রতি কভু করিও না হেলা।
আজি যে সময় গত হইল তোমার
আসিবে না পুনঃ তাহা আসিবে না আর।
তাই বলি বৃথা কাল করিও না ক্ষয়
আপনার কাজ কর থাকিতে সময়।
...

বড় কে / হরিশচন্দ্র মিত্র

...
আপনারে বড় বলে, বড় সেই নয়
লোকে যারে বড় বলে, বড় সেই হয়।
বড় হওয়া সংসারেতে কঠিন ব্যাপার
সংসারে সে বড় হয়, বড় গুণ যার।
গুণেতে হইলে বড়, বড় বলে সবে
বড় যদি হতে চাও, ছোট হও তবে।
...

দুঃখের তুলনা / কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার

...
একদা ছিল না 'জুতো' চরণ-যুগলে
দহিল হৃদয় মম সেই ক্ষোভানলে।
ধীরে ধীরে চুপি চুপি দুঃখাকুল মনে,
গেলাম ভজনালয়ে ভজন কারণে !
দেখি তথা এক জন, পদ নাহি তার,
অমনি 'জুতো'র খেদ ঘুচিল আমার,
পরের অভাব মনে করিলে চিন্তন
নিজের অভাব ক্ষোভ রহে কতক্ষণ ?
...

বুঝিবে সে কিসে / কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার

...
চিরসুখীজন ভ্রমে কি কখন
ব্যথিতবেদন বুঝিতে পারে !
কি যাতনা বিষে,           বুঝিবে সে কিসে
কভু আশীবিষে দংশেনি যারে !
যতদিন ভবে,               না হবে না হবে,
তোমার অবস্থা আমার সম।
ঈষৎ হাসিবে,               শুনে না শুনিবে
বুঝে না বুঝিবে, যাতনা মম।
...

স্বাধীনতা-হীনতায় / রঙ্গলাল বন্দোপাধ্যায়

...
স্বাধীনতা-হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে,
কে বাঁচিতে চায় ?
দাসত্ব শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে,
কে পরিবে পায়।।
কোটি কল্প দাস থাকা নরকের প্রায় হে,
নরকের প্রায়।
দিনেকের স্বাধীনতা, স্বর্গ-সুখ তায় হে,
স্বর্গ-সুখ তায়।।...
সার্থক জীবন আর বাহু-বল তার হে,
বাহু-বল তার।
আত্মনাশে যেই করে দেশের উদ্ধার হে,
দেশের উদ্ধার।।...
অতএব রণভূমে চল ত্বরা যাই হে,
চল ত্বরা যাই।
দেশহিতে মরে যেই, তুল্য তার নাই হে,
তুল্য তার নাই।।
...

Saturday, May 15, 2010

আমার পণ / মদনমোহন তর্কালঙ্কার

...
সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি,
সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি।
আদেশ করেন যাহা মোর গুরুজনে,
আমি যেন সেই কাজ করি ভাল মনে।
ভাইবোন সকলেরে যেন ভালবাসি,
এক সাথে থাকি যেন সবে মিলেমিশি।
ভাল ছেলেদের সাথে মিশে করি খেলা,
পাঠের সময় যেন নাহি করি হেলা।
সুখী যেন নাহি হই আর কারো দুখে,
মিছে কথা কভু যেন নাহি আসে মুখে।
সাবধানে যেন লোভ সামলিয়ে থাকি,
কিছুতে কাহারে যেন নাহি দেই ফাঁকি।
ঝগড়া না করি যেন কভু কারো সনে,
সকালে উঠিয়া এই বলি মনে মনে।
...

কে ? / ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত

...
বল দেখি এ জগতে ধার্মিক কে হয়,
সর্বজীবে দয়া যার, ধার্মিক সে হয়।
বল দেখি এ জগতে সুখী বলি কারে,
সতত আরোগী যেই, সুখী বলি তারে।
বল দেখি এ জগতে বিজ্ঞ বলি কারে,
হিতাহিত বোধ যার, বিজ্ঞ বলি তারে।
বল দেখি এ জগতে ধীর বলি কারে,
বিপদে যে স্থির থাকে, ধীর বলি তারে।
বল দেখি এ জগতে মূর্খ বলি কারে,
নিজ কার্য নষ্ট করে, মূর্খ বলি তারে।
বল দেখি এ জগতে সাধু বলি কারে,
পরের যে ভালো করে, সাধু বলি তারে।
বল দেখি এ জগতে জ্ঞানী বলি কারে,
নিজ বোধ আছে যার, জ্ঞানী বলি তারে।
বল দেখি এ জগতে সার বলি কারে,
ঈশ্বরের ভক্ত যেই, সার বলি তারে।
...

স্বদেশী ভাষা / রামনিধি গুপ্ত

...
নানান্ দেশের নানান্ ভাষা।
বিনে স্বদেশীয় ভাষা,
পূরে কি আশা ?
কত নদী সরোবর কিবা ফল চাতকীর
ধারাজল বিনে কভু
           ঘুচে কি তৃষা ?
...

বঙ্গবাণী / আবদুল হাকিম

...
কিতাব পড়িতে যার নাহিক অভ্যাস।
সে সবে কহিল মোতে মনে হাবিলাষ।।
তে কাজে নিবেদি বাংলা করিয়া রচন।
নিজ পরিশ্রম তোষি আমি সর্বজন।।
আরবি ফারসি শাস্ত্রে নাই কোন রাগ।
দেশী ভাষে বুঝিতে ললাটে পুরে ভাগ।।
আরবি ফারসি হিন্দে নাই দুই মত।
যদি বা লিখয়ে আল্লা নবীর ছিফত।।
যেই দেশে যেই বাক্য কহে নরগণ।
সেই বাক্য বুঝে প্রভু আগে নিরঞ্জন।।
সর্ববাক্য বুঝে প্রভু কিবা হিন্দুয়ানী।
বঙ্গদেশী বাক্য কিবা যত ইতি বাণী।।
মারফত ভেদে যার নাহিক গমন।
হিন্দুর অক্ষর হিংসে সে সবের গণ।।
যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।।
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়।
নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশ ন যায়।।
মাতা পিতামহ ক্রমে বঙ্গেত বসতি।
দেশী ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি।।
...