Monday, May 17, 2010

কোন দেশে / সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত

...
কোন্ দেশেতে তরুলতা
        সকল দেশের চাইতে শ্যামল ?
কোন্ দেশেতে চলতে গেলেই
        দলতে হয় রে দূর্বা কোমল ?
কোথায় ফলে সোনার ফসল,
        সোনার কমল ফোটে রে ?
সে আমাদের বাংলাদেশ,
        আমাদেরই বাংলা রে !

কোথায় ডাকে দোয়েল-শ্যামা
        ফিঙে নাচে গাছে গাছে ?
কোথায় জলে মরাল চলে,
        মরালী তার পাছে পাছে;
বাবুই কোথা বাসা বোনে,
        চাতক বারি যাচে রে ?
সে আমাদের বাংলাদেশ
        আমাদেরই বাংলা রে !
...

অধম ও উত্তম / সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত

...
কুকুর আসিয়া এমন কামড়
           দিল পথিকের পায়
কামড়ের চোটে বিষদাঁত ফুটে
           বিষ লেগে গেল তায়।

ঘরে ফিরে এসে রাত্রে বেচারা
           বিষম ব্যথায় জাগে,
মেয়েটি তাহার তারি সাথে হায়
           জাগে শিয়রের আগে।

বাপেরে সে বলে ভর্ৎসনা-ছলে
           কপালে রাখিয়া হাত,
"তুমি কেন বাবা, ছেড়ে দিলে তারে
           তোমার কি নেই দাঁত !"

মানুষ জাতি / সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত

...
জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে
            সে জাতির নাম মানুষ জাতি;
এক পৃথিবীর স্তন্যে লালিত
            একই রবি শশী মোদের সাথী।
শীতাতপ ক্ষুধা তৃষ্ণার জ্বালা
            সবাই আমরা সমান বুঝি,
কচি কাঁচাগুলি ডাঁটো করে তুলি
            বাঁচিবার তরে সমান যুঝি।
দোসর খুঁজি ও বাসর বাঁধি গো,
            জলে ডুবি, বাঁচি পাইলে ডাঙ্গা,
কালো আর ধলো বাহিরে কেবল
            ভিতরে সবারই সমান রাঙা।
বাহিরের ছোপ আঁচড়ে সে লোপ
            ভিতরের রং পলকে ফোটে,
বামুন, শূদ্র, বৃহৎ, ক্ষুদ্র
            কৃত্রিম ভেদ ধুলায় লোটে।...

চাঁদ / বেগম রোকেয়া

...
নিষ্ঠুর নিদয় শশী             সুদূর গগনে বসি,
কি দেখিছ ? জগতের হিংসা পাপরাশি ?
মোরে দেখে পায় তব হাসি ?

যখন তাপিত প্রাণে           চাহি তব মুখ পানে,
তোমার এ হাসি দেখে হিংসা হয় চিতে।
-আমি কেন পারি না হাসিতে ?

জগতের দুঃখ-ভয়           তোমাদের সঙ্গী নয়,
পাপ-তাপ তোমাদের কাছে নাহি যায়
-তারা কেন আমারে কাঁদায় ?

তুমি নীলিমার দেশে         যথা ইচ্ছা যাও ভেসে,
অনন্ত আকাশে যেন তোমারি আলয় !
-আমি কেন পাই না আশ্রয় ?
...

মোদের গরব, মোদের আশা / অতুলপ্রসাদ সেন

...
মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা !
তোমার কোলে, তোমার বোলে, কতই শান্তি ভালবাসা !
কি যাদু বাংলা গানে ! -গান গেয়ে দাঁড় মাঝি টানে,
                      এমন কোথা আর আছে গো !
গেয়ে গান নাচে বাউল, গান গেয়ে ধান কাটে চাষা।।
এই ভাষাতেই নিতাই গোরা, আনল দেশে ভক্তি-ধারা,
                      মরি হায়, হায় রে !
আছে কই এমন ভাষা, এমন দুঃখ-শ্রান্তি-নাশা !
বিদ্যাপতি, চণ্ডী, গোবিন, হেম, মধু, বঙ্কিম, নবীন-
                      আরো কত মধুপ গো !
ঐ ফুলেরি মধুর রসে, বাঁধলো সুখে মধুর বাসা।।
বাজিয়ে রবি তোমার বীণে, আনলো মালা জগৎ জিনে-
                      গরব কোথায় রাখি গো !
তোমার চরণ-তীর্থে আজি, জগৎ করে যাওয়া-আসা।
ওই ভাষাতেই প্রথম বোলে, ডাকনু মায়ে 'মা', 'মা' বলে;
ওই ভাষাতেই বলবো 'হরি', সাঙ্গ হলে কাঁদা-হাসা।।
...

হারাধনের দশটি ছেলে ১ / যোগীন্দ্রনাথ সরকার

...
হারাধনের দশটি ছেলে
          ঘোরে পাড়াময়,
একটি কোথা হারিয়ে গেল
          রইল বাকি নয়।

হারাধনের নয়টি ছেলে
          কাটতে গেল কাঠ,
একটি কেটে দু'খান হল
          রইল বাকি আট।

হারাধনের আটটি ছেলে
          বসলো খেতে ভাত,
একটির পেট ফেটে গেল
          রইল বাকি সাত।

মজার দেশ / যোগীন্দ্রনাথ সরকার

...
এক যে আছে মজার দেশ, সব রকমে ভালো,
রাত্তিরেতে বেজায় রোদ, দিনে চাঁদের আলো !
       আকাশ সেথা সবুজবরণ গাছের পাতা নীল;
       ডাঙ্গায় চরে রুই কাতলা জলের মাঝে চিল !
সেই দেশেতে বেড়াল পালায়, নেংটি-ইঁদুর দেখে;
ছেলেরা খায় 'ক্যাস্টর-অয়েল' -রসগোল্লা রেখে !
       মণ্ডা-মিঠাই তেতো সেথা, ওষুধ লাগে ভালো;
       অন্ধকারটা সাদা দেখায়, সাদা জিনিস কালো !
ছেলেরা সব খেলা ফেলে বই নে বসে পড়ে;
মুখে লাগাম দিয়ে ঘোড়া লোকের পিঠে চড়ে !
       ঘুড়ির হাতে বাঁশের লাটাই, উড়তে থাকে ছেলে;
       বড়শি দিয়ে মানুষ গাঁথে, মাছেরা ছিপ্ ফেলে !

বিনয় / রজনীকান্ত সেন

...
বিজ্ঞ দার্শনিক এক আইল নগরে,
ছুটিল নগরবাসী জ্ঞান-লাভ তরে;
সুন্দর-গম্ভীর-মূর্তি, শান্ত-দরশন,
হেরি সবে ভক্তি ভরে বন্দিল চরণ।
সবে কহে, "শুনি, তুমি জ্ঞানী অতিশয়,
দু'একটি তত্ত্ব-কথা কহ মহাশয়।"
দার্শনিক বলে, "ভাই, কেন বল জ্ঞানী ?
'কিছু যে জানি না', আমি এই মাত্র জানি।"
...

পরোপকার / রজনীকান্ত সেন

...
নদী কভু পান নাহি করে নিজ জল,
তরুগণ নাহি খায় নিজ নিজ ফল,
গাভী কভু নাহি করে নিজ দুগ্ধ পান,
কাষ্ঠ, দগ্ধ হয়ে, করে পরে অন্নদান,
স্বর্ণ করে নিজরূপে অপরে শোভিত,
বংশী করে নিজস্বরে অপরে মোহিত,
শস্য জন্মাইয়া, নাহি খায় জলধরে,
সাধুর ঐশ্বর্য শুধু পরহিত-তরে।
...

স্বাধীনতার সুখ / রজনীকান্ত সেন

...
বাবুই পাখিরে ডাকি, বলিছে চড়াই-
"কুঁড়ে ঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই;
আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকা 'পরে,
তুমি কত কষ্ট পাও রোদ, বৃষ্টি, ঝড়ে।"
বাবুই হাসিয়া কহে- "সন্দেহ কি তায় ?
কষ্ট পাই, তবু থাকি নিজের বাসায়;
পাকা হোক, তবু ভাই, পরের ও বাসা,
নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর, খাসা।"
...

পাছে লোকে কিছু বলে / কামিনী রায়

...
করিতে পারি না কাজ
              সদা ভয় সদা লাজ
সংশয়ে সংকল্প সদা টলে,-
              পাছে লোকে কিছু বলে।
আড়ালে আড়ালে থাকি
              নীরবে আপনা ঢাকি,
সম্মুখে চরণ নাহি চলে
              পাছে লোকে কিছু বলে।
হৃদয়ে বুদবুদ মত
              উঠে শুভ্র চিন্তা কত,
মিশে যায় হৃদয়ের তলে,
              পাছে লোকে কিছু বলে।
কাঁদে প্রাণ যবে আঁখি
              সযতনে শুষ্ক রাখি;-
নিরমল নয়নের জলে,
              পাছে লোকে কিছু বলে।
একটি স্নেহের কথা
              প্রশমিতে পারে ব্যথা,-
চলে যাই উপেক্ষার ছলে,
              পাছে লোকে কিছু বলে।

নন্দলাল / দ্বিজেন্দ্রলাল রায়

...
নন্দলাল তো একদা একটা করিল ভীষণ পণ-
স্বদেশের তরে, যা করেই হোক, রাখিবেই সে জীবন।
সকলে বলিল, 'আ-হা-হা কর কি, কর কি, নন্দলাল' ?
নন্দ বলিল, 'বসিয়া বসিয়া রহিব কি চিরকাল ?
আমি না করিলে কে করিবে আর উদ্ধার এই দেশ ?'
তখন সকলে বলিল- 'বাহবা বাহবা বাহবা বেশ !'

নন্দর ভাই কলেরায় মরে, দেখিবে তাহারে কেবা !
সকলে বলিল, 'যাও না নন্দ, করো না ভায়ের সেবা।'
নন্দ বলিল, 'ভায়ের জন্য জীবনটা যদি দিই-
না হয় দিলাম, -কিন্তু অভাগা দেশের হইবে কি ?
বাঁচাটা আমার অতি দরকার, ভেবে দেখি চারি দিক্।'
তখন সকলে বলিল- 'হাঁ হাঁ হাঁ, তা বটে, তা বটে, ঠিক !'

বীরপুরুষ / রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

...
            মনে করো, যেন বিদেশ ঘুরে
            মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে।
তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চ'ড়ে
দরজা দুটো একটুকু ফাঁক ক'রে,
আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ার 'পরে
            টগবগিয়ে তোমার পাশে পাশে।
রাস্তা থেকে ঘোড়ার খুরে খুরে
রাঙা ধুলোয় মেঘ উড়িয়ে আসে।

তালগাছ / রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

...
তালগাছ          এক পায়ে দাঁড়িয়ে
                    সব গাছ ছাড়িয়ে
                         উঁকি মারে আকাশে।
মনে সাধ,        কালো মেঘ ফুঁড়ে যায়
                    একেবারে উড়ে যায়;
                         কোথা পাবে পাখা সে ?
তাই তো সে      ঠিক তার মাথাতে
                    গোল গোল পাতাতে
                    ইচ্ছাটি মেলে তার,-
মনে মনে         ভাবে, বুঝি ডানা এই,
                    উড়ে যেতে মানা নেই
                         বাসাখানি ফেলে তার।

মাস্টারবাবু / রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

...
আমি আজ কানাই মাস্টার,
           পোড়ো মোর বেড়াল ছানাটি।
আমি ওকে মারি নে মা বেত,
           মিছিমিছি বসি নিয়ে কাঠি।
রোজ রোজ দেরি করে আসে,
           পড়াতে দেয় না ও তো মন,
ডান পা তুলিয়ে তোলে হাই
           যত আমি বলি, 'শোন্, শোন্'।
দিনরাত খেলা খেলা খেলা,
           লেখা পড়ায় ভারি অবহেলা।
আমি বলি 'চ ছ জ ঝ ঞ',
ও কেবল বলে 'মিয়োঁ' মিয়োঁ'।