Thursday, November 19, 2009

কাজ / আখতার হুসেন

...

মা ও বলেন , বাবাও বলেন
অভিযোগের সুরে
আমি নাকি আলসে এবং কুড়ে।
ঘরের কোনো কাজ করি না মিনু যেমন করে
সারাটা দিন ধরে।

তাইতো মিনু সবার কাছে লক্ষ্মী সোনা মেয়ে
বায়না যখন যা ধরে তাই তখ্খুনি যায় পেয়ে।

মিনুর কী কাজ ? কখনো বা মসলা পাতি বাটে
মা’র হয়ে বাসন-থালা যায় যে নিয়ে ঘাটে।
কলসি ভরে জল আনে আর
কাঁথায় নক্সা বোনে
কখনো বা ঝাড় দিয়ে যায়
দাওয়ায় , ঘরের কোণে।

আর আমি ? কাজ করি যে কতো সারাটা দিন ধরে
সে সব কথা একবারও কেউ , কেউ বলে না ঘরে।
কালবোশেখীর ঝড়
ভাঙলে পরে গাছের ডানা , পাখির বাসা-ঘর
আমি যে যাই ছুটে
খড়-কুটো সব খুঁজি গিয়ে মাঠপারে , প্রান্তরে
ওদের বাসা দেই বানিয়ে সযত্নে তারপরে।

এগুলো নয় কাজ ?
মা-বাবাকে বলবো গিয়ে আজ।
কাকলীদের খুড়ো
বড্ডো যে থুত্থুরো
শ্বাস নেন খুব ঘন ঘন পথ চলতে গেলে
থমকে দাঁড়ান চৌ-মাথাটার সাঁকোর ধারে এলে।

তখন ছুটে কেউ তো আসে নাকো
আমিই ছুটি আমিই তাঁকে পার করিয়ে
দেই যে বাঁশের সাঁকো।

এগুলো নয় কাজ ?
মা-বাবাকে বলবো গিয়ে আজ।
আকাশ-ভাঙা ঝমঝমানো ভর বর্ষা শেষে
দূর-বিদেশের রং বে-রঙের পাখিরা সব এসে-
শালুক বিলে বসায় যখন মেলা
মনের সুখে গান গায় আর কেবল খেলে খেলা ;
শুনতে পেয়ে তাদের সে গান , হরেক রকম ডাক
ছুটে আসে শালুক বিলে শিকারীদের ঝাঁক-
তখন আমি ঢিলের পরে ঢিলটা ওদের ছুঁড়ে
শিকারীদের নাগাল থেকে দেই পাঠিয়ে দূরে।

এগুলো নয় কাজ ?
মা-বাবাকে বলবো গিয়ে আজ।
...

ভয়ের চোটে / আল মাহমুদ

...

অঙ্ক নিয়ে বসলে আমার কখন কী যে হয়
টেবিলটাও পর হয়ে যায় বইগুলো সব ভয়।
ভয়ের চোটে ভাবতে থাকি শহর ভেঙে কেউ
দালান কোঠা বিছিয়ে দিয়ে তোলে খেতের ঢেউ।
রাস্তাগুলো নদী এবং গলিরা সব খাল
ইলেকট্রিকের খাম্বাগুলো পাল্টে হলো তাল।
মোটরগাড়ি গরুর পালে হাম্বা তুলে হাঁটে
পুলিশগুলো গুলিস্তানে নিড়ানি ঘাস কাটে।
আব্বা হলেন কাকতাড়ুয়া আম্মা হলুদ পাখি
বুবুরা সব ভুঁইকুমড়ো পাতায় ঢেকে রাখি।

সবাই যখন পাল্টে গেছে নিজের ঘরে নাই
আমিই তখন ইচ্ছে মতন খোকন হয়ে যাই।
কেউ বলে না আঁক কষতে কেউ বলে না লেখ্
কেউ ধরে না কানের লতি, কেউ বলে না শেখ্।
ঢাকা শহর, ঢাকা শহর সবুজ হয়ে যাও
কলেজগুলো সর্ষে বাগান ভার্সিটিতে লাউ।
...

বাণিজ্যেতে যাবো আমি / আশরাফ সিদ্দিকী

...

বাণিজ্যেতে যাবো আমি সিন্দাবাদের মতো
পাহাড়-সাগর-অরণ্য-মাঠ ছাড়িয়ে শত শত।
মাগো আমায় দাও সাজিয়ে ময়ূরপঙ্খীখানা
মাগো আমি আজকে তোমার শুনবো না আর মানা।

কোথায় আছে ঘুমতি নদী কোথায় মায়াবন ?
কোথায় আছে সোনার টিয়া কোথায় হীরামন ?
সোনার আলোর মুকুটপরা কোন্ পাহাড়ের পার
ঝিলিক্ মারে ক্ষীর সাগরে গজমোতির হার ?
সে-সব দেশে যাবার তরে মন যে কেমন করে
মাগো আমার ময়ূরপঙ্খী সাজাও ত্বরা ক’রে।
সে-সব দেশে যাবো আমি শুনবো না আর মানা-
মাগো আমায় দাও সাজিয়ে ময়ূরপঙ্খীখানা।

শম্ শম্ শম্ হাওয়ার বেগে কাঁপবে নায়ের পাল
সিন্দাবাদের মতন আমি ধ’রবো ক’ষে হাল।
সাতটি হাজার সবুজ সেনার সাতটি হাজার দাঁড়
ঝপ্ ঝপ্ ঝপ্ তালে তালে ফেলবে বারে বার।
শাঁই শাঁই শাঁই ময়ূরপঙ্খী ছুটবে তীরের মতো
অচিন্ পাথার অচিন্ নদী ছাড়িয়ে শত শত।
মাগো আমায় দাও সাজিয়ে ময়ূরপঙ্খীখানা
মাগো আমি আজকে তোমার শুনবো না আর মানা।
...

স্বদেশ আমার / আহসান হাবীব

...

    জেলের সেলে বন্দী ছিলো
মৃতের স্তুপের অন্ধকারে বন্দী ছিলো
বন্দী ছিলো বন্ধ দুয়ার
        ভয় থমথম ঘরের মাঝে।
শহর জুড়ে কারফ্যু তার কাফন ছড়ায়
        সেই কাফনে বন্দী ছিলো।

ওরা তখন মন্ত্রপুত মশাল নিয়ে নামলো পথে
মৃতের স্তুপে ফোটালো ফুল
নতুন প্রাণে গাঁথলো নতুন দীপাবলি।

আগুন জ্বলে। জ্বলতে থাকে পাশব আঁধার
গ্রাম নগরে রাত পেরিয়ে, রাত পেরিয়ে
                রাত পেরিয়ে
সূর্য নামে।

তখন দেখি
আলোর মুকুট মাথায় পরে
ভুবন জুড়ে বাইরে এলো বন্দিনী মা বাংলা আমার
                স্বদেশ আমার।
...

ঘুমের আগে / আহসান হাবীব

...

জানো মা, পাখিরা বড় বোকা, ওরা কিছুই জানেনা।
যত বলি, কাছে এসো, শোনো শোনো, কিছুতেই মানেনা।

মিছেমিছি কেন ওরা ভয় পায়, ভয়ের কি আছে ?
বোঝেনা বোকারা, আমি ভালোবাসি তাই ডাকি কাছে।
দেখোনা, যখন কাল আমাদের আমবাগানের
পুবধারে ওরা সব বসিয়েছে আসর গানের-
আমি গিয়ে চুপ চুপে কিছু দূরে বসেছি যখন,
গান ভুলে বোকাগুলো একসাথে পালালো তখন।
ওরা কি জানেনা, আমি গান বড় ভালোবাসি, তাই
যখনি ওদের দেখি চুপে চুপে কাছে চলে যাই !

আচ্ছা মা, বলো দেখি কি করে কাটাব এই ভয়,
কি পেলে তখন ওরা সবচেয়ে বেশি খুশি হয় ?
সাদা কড়ি ওদের কি ভাল লাগে ? আমার যেমন
ছোট লাল ঘুড়ি আছে, মাজা সূতো, ওদের তেমন
আছে না কি ? কিছু নেই ? বেশ কথা, না-ই যদি থাকে
বোকারা নিজেরা এসে বলে যেতে পারে ত আমাকে,
আমি ত দিতেই চাই, বোকারা যে কখনো আসে না।
জানি, ওরা পাখি কি-না, মানুষকে ভালোই বাসে না।

বলোনা মা, কি করলে পাখিরাও খুব ভালোবাসে,
কি করলে পাখিরাও ভালোবেসে খুব কাছে আসে।
...

Tuesday, November 17, 2009

প্রতীক্ষা / রফিক আজাদ

...
এমন অনেক দিন গেছে
আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থেকেছি,
হেমন্তে পাতা-ঝরার শব্দ শুনবো ব’লে
নিঃশব্দে অপেক্ষা করেছি বনভূমিতে-
কোনো বন্ধুর জন্যে
কিংবা অন্য অনেকের জন্যে
হয়তো বা ভবিষ্যতেও অপেক্ষা করবো...
এমন অনেক দিনই তো গেছে
কারো অপেক্ষায় বাড়ি ব’সে আছি-
হয়তো কেউ বলেছিলো, “অপেক্ষা ক’রো
একসঙ্গে বেরুবো।”

অবেলায় শঙ্খধ্বনি / রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ

...

অতোটা হৃদয় প্রয়োজন নেই,
কিছুটা শরীর কিছুটা মাংস মাধবীও চাই।
এতোটা গ্রহণ এতো প্রশংসা প্রয়োজন নেই
      কিছুটা আঘাত অবহেলা চাই প্রত্যাখান।
                সাহস আমাকে প্ররোচনা দেয়
জীবন কিছুটা যাতনা শেখায়,
ক্ষুধা ও খরার এই অবেলায়
অতোটা ফুলের প্রয়োজন নেই।

বুকে ঘৃণা নিয়ে নীলিমার কথা
অনাহারে ভোগা মানুষের ব্যথা
প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন নেই-
করুণাকাতর বিনীত বাহুরা ফিরে যাও ঘরে।

নষ্ট যুবক ভ্রষ্ট আঁধারে কাঁদো কিছুদিন
কিছুদিন বিষে দহনে দ্বিধায় নিজেকে পোড়াও
না হলে মাটির মমতা তোমাতে হবে না সুঠাম,
না হলে আঁধার আরো কিছুদিন ভাসাবে তোমাকে।

অতোটা প্রেমের প্রয়োজন নেই
ভাষাহীন মুখ নিরীহ জীবন
প্রয়োজন নেই- প্রয়োজন নেই

কিছুটা হিংস্র বিদ্রোহ চাই কিছুটা আঘাত
রক্তে কিছুটা উত্তাপ চাই, উষ্ণতা চাই
চাই কিছু লাল তীব্র আগুন।
...

মনে পড়ে সুদূরের মাস্তুল / রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ

...

পেছনে তাকালে কেন মূক হয়ে আসে ভাষা !
মনে পড়ে সেই সব দুপুরের জলাভূমি,
সেই সব বেতফল, বকুল কুড়ানো ভোর,
আহা সেই রাঙাদির আঁচলতলের উত্তাপ,
                     মনে পড়ে.......

মনে পড়ে, বন্দরে সেই সব কালোরাত,
ঈগলের মতো ডানা সেই বিশাল গভীর রাতে,
একটি কিশোর এসে চুপি চুপি সাগরের কূলে
                      দাঁড়াতো একাকী
তন্ময় চোখে তার রাশি রাশি বিস্ময় নিয়ে।

কবে তারে ডাক দিয়ে নিয়ে গেলো যৌবন সুচতুর,
কবে তারে ডেকে নিলো মলিন ইটের কালো সভ্যতা !

সবুজ ছায়ার নিচে ঘুমে চোখ ঢুলে এলে
মা যাকে শোনাতো সেই তুষারদেশের কথা,
তার চোখে আজ এতো রাতজাগা ক্লান্তির শোক !

পেছনে তাকালে কেন নিরবতা আসে চোখে !
মনে পড়ে- জ্যোৎস্নায় ঝলোমলো বালুচর,
একটি কিশোর- তার তন্ময় দুটি চোখে
রাশি রাশি কালোজল- সুদূরের মাস্তুল
                       মনে পড়ে.....
...

কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প / রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ

...

তাঁর চোখ বাঁধা হলো।
বুটের প্রথম লাথি রক্তাক্ত করলো তার মুখ।
থ্যাতলানো ঠোঁটজোড়া লালা-রক্তে একাকার হলো,
জিভ নাড়তেই দুটো ভাঙা দাঁত ঝরে পড়লো কংক্রিটে।
মা.....মাগো..... চেঁচিয়ে উঠলো সে।

পাঁচশো পঞ্চান্ন মার্কা আধ-খাওয়া একটা সিগারেট
প্রথমে স্পর্শ করলো তার বুক।
পোড়া মাংসের উৎকট গন্ধ ছড়িয়ে পড়লো ঘরের বাতাসে।
জ্বলন্ত সিগারেটের স্পর্শ
তার দেহে টসটসে আঙুরের মতো ফোস্কা তুলতে লাগলো।

দ্বিতীয় লাথিতে ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে গেলো দেহ,
এবার সে চিৎকার করতে পারলো না।

তাকে চিৎ করা হলো।
পেটের ওপর উঠে এলো দু’জোড়া বুট, কালো ও কর্কশ।
কারণ সে তার পাকস্থলির কষ্টের কথা বলেছিলো,
বলেছিলো অনাহার ও ক্ষুধার কথা।

সে তার দেহের বস্ত্রহীনতার কথা বলেছিলো-
বুঝি সে-কারণে
ফর ফর করে টেনে ছিঁড়ে নেয়া হলো তার সার্ট।
প্যান্ট খোলা হলো। সে এখন বিবস্ত্র, বীভৎস।

তার দুটো হাত-
মুষ্টিবদ্ধ যে-হাত মিছিলে পতাকার মতো উড়েছে সক্রোধে,
যে-হাতে সে পোস্টার সেঁটেছে, বিলিয়েছে লিফলেট,
লোহার হাতুড়ি দিয়ে সেই হাত ভাঙা হলো।
সেই জীবন্ত হাত, জীবন্ত মানুষের হাত।

তার দশটি আঙুল-
যে-আঙুলে ছুঁয়েছে সে মার মুখ, ভায়ের শরীর,
প্রেয়সীর চিবুকের তিল।
যে-আঙুলে ছুঁয়েছে সে সাম্যমন্ত্রে দীক্ষিত সাথীর হাত,
স্বপ্নবান হাতিয়ার,
বাটখারা দিয়ে সে-আঙুল পেষা হলো।
সেই জীবন্ত আঙুল, মানুষের জীবন্ত উপমা।
লোহার সাঁড়াশি দিয়ে,
একটি একটি করে উপড়ে নেয়া হলো তার নির্দোষ নখগুলো।
কী চমৎকার লাল রক্তের রঙ।

সে এখন মৃত।
তার শরীর ঘিরে থোকা থোকা কৃষ্ণচূড়ার মতো
ছড়িয়ে রয়েছে রক্ত, তাজা লাল রক্ত।

তার থ্যাতলানো একখানা হাত
পড়ে আছে এদেশের মানচিত্রের ওপর,
আর সে হাত থেকে ঝরে পড়ছে রক্তের দুর্বিনীত লাভা-
...

Monday, November 16, 2009

জেলখানার চিঠি / নাজিম হিকমত

...

প্রিয়তমা আমার,
তোমার শেষ চিঠিতে
তুমি লিখেছো:
মাথা আমার ব্যথায় টনটন করছে,
দিশেহারা আমার হৃদয়।
তুমি লিখেছো:
যদি ওরা তোমাকে ফাঁসি দেয়
তোমাকে যদি হারাই,
            আমি বাঁচবো না।

তুমি বেঁচে থাকবে প্রিয়তমা বধূ আমার
আমার স্মৃতি কালো ধোঁয়ার মতো হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে
তুমি বেঁচে থাকবে, আমার হৃদয়ের রক্তকেশী ভগিনী,
বিংশ শতাব্দীতে,
            মানুষের শোকের আয়ু
                        বড়জোর এক বছর।

মৃত্যু ...
দড়ির একপ্রান্তে দোদুল্যমান শবদেহ
আমার কাম্য নয়, সেই মৃত্যু।
কিন্তু প্রিয়তমা আমার, তুমি জেনো
জল্লাদের লোমশ হাত
যদি আমার গলায়
ফাঁসির দড়ি পরায়
নাজিমের নীল চোখে ওরা বৃথাই খুঁজে ফিরবে ভয়।
অন্তিম ঊষার অস্ফুট আলোয়
আমি দেখব, আমার বন্ধুদের, তোমাকে দেখব।
আমার সঙ্গে কবরে যাবে
শুধু আমার
            এক অসমাপ্ত গানের বেদনা।
বধূ আমার,
তুমি আমার কোমল প্রাণ মৌমাছি
চোখ তোমার মধুর চেয়েও মিষ্টি।
কেন তোমাকে আমি লিখতে গেলাম
ওরা আমাকে ফাঁসি দিতে চায়
বিচার সবেমাত্র শুরু হয়েছে
আর মানুষের মুণ্ডুটা তো বোঁটার ফুল নয়
যে ইচ্ছে করলেই ছিঁড়ে নেবে।

ও নিয়ে ভেব না
ওসব বহু দূরের ভাবনা
হাতে যদি টাকা থাকে
আমার জন্যে কিনে পাঠিও গরম একটা পাজামা
পায়ে আমার বাত ধরেছে।
ভুলে যেও না
স্বামী যার জেলখানায়
            তার মনে যেন সব সময় স্ফুর্তি থাকে
বাতাস আসে, বাতাস যায়
চেরীর একই ডাল একই ঝড়ে
            দু’বার দোলে না।

গাছে গাছে পাখির কাকলি
পাখাগুলো উড়তে চায়।
জানলা বন্ধ:
টান মেরে খুলতে হবে।

আমি তোমাকে চাই:
তোমার মত রমণীয় হোক জীবন
আমার বন্ধু, আমার প্রিয়তমার মত।...

আমি জানি, দুঃখের ডালি
আজও উজাড় হয়নি
কিন্তু একদিন হবে।
নতজানু হয়ে আমি চেয়ে আছি মাটির দিকে
উজ্জ্বল নীল শাখার মঞ্জুরিতে ফুলের দিকে আমি তাকিয়ে
তুমি যেন মৃন্ময়ী বসন্ত, আমার প্রিয়তমা
আমি তোমার দিকে তাকিয়ে।

মাটিতে পিঠ রেখে আমি দেখি আকাশকে
তুমি যেন মধুমাস, তুমি আকাশ
আমি তোমাকে দেখছি, প্রিয়তমা।

রাত্রির অন্ধকারে, গ্রাম দেশে শুকনো পাতায় আমি জ্বালিয়েছিলাম আগুন
আমি স্পর্শ করছি সেই আগুন
নক্ষত্রের নীচে জ্বালা অগ্নিকুণ্ডের মত তুমি
আমার প্রিয়তমা, আমি তোমাকে স্পর্শ করছি।
আমি আছি মানুষের মাঝখানে, ভালোবাসি আমি মানুষকে
ভালোবাসি আন্দোলন,
ভালোবাসি চিন্তা করতে,
আমার সংগ্রামকে আমি ভালোবাসি
আমার সংগ্রামের অন্তস্থলে মানুষের আসনে তুমি আসীন
প্রিয়তমা আমার, আমি তোমাকে ভালোবাসি।

রাত এখন ন'টা
ঘণ্টা বেজে গেছে গুমটিতে
সেলে দরোজা তালাবন্ধ হবে এক্ষুনি।
এবার জেলখানায় একটু বেশী দিন কাটল
আটটা বছর।

বেঁচে থাকার অনেক আশা, প্রিয়তমা
তোমাকে ভালোবাসার মতই একাগ্র বেঁচে থাকা।
কী মধুর, কী আশায় রঙিন তোমার স্মৃতি।...
কিন্তু আর আমি আশায় তুষ্ট নই,
আর আমি শুনতে চাইনা গান।
আমার নিজের গান এবার আমি গাইবো।

আমাদের ছেলেটা বিছানায় শয্যাগত
বাপ তার জেলখানায়
তোমার ভারাক্রান্ত মাথাটা ক্লান্ত হাতের উপর এলানো
আমি আর আমাদের এই পৃথিবী একই সুচাগ্রে দাঁড়িয়ে।

দুঃসময় থেকে সুসময়ে
মানুষ পৌঁছে দেবে মানুষকে
আমাদের ছেলেটা নিরাময় হয়ে উঠবে
তার বাপ খালাস পাবে জেল থেকে
তোমার সোনালী চোখে উপচে পড়বে হাসি
আমার আর আমাদের এই পৃথিবী একই সূচাগ্রে দাঁড়িয়ে !

যে সমুদ্র সব থেকে সুন্দর
তা আজও আমরা দেখি নি।
সব থেকে সুন্দর শিশু
আজও বেড়ে ওঠেনি।
মধুরতম যে কথা আমি বলতে চাই
সে কথা আজও আমি বলিনি।

কাল রাতে তোমাকে আমি স্বপ্ন দেখলাম
মাথা উঁচু করে
ধূসর চোখ মেলে তুমি আবছা আমার দিকে তাকিয়ে
তোমার আর্দ্র ওষ্ঠাধর কম্পমান
কিন্তু তোমার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম না।
কৃষ্ণপক্ষ রাত্রে কোথাও আনন্দ সংবাদের মতো ঘড়ির টিক্ টিক্ আওয়াজ
বাতাসে গুন্ গুন্ করছে মহাকাল
আমার ক্যানারীর লাল খাঁচায়
গানের একটি কলি
লাঙ্গল চষা ভূঁইতে
মাটির বুকফুঁড়ে উদগত অঙ্কুরের দুরন্ত কলরব
আর এক মহিমান্বিত জনতার বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত ন্যায্য অধিকার
তোমার আর্দ্র ওষ্ঠাধর কম্পমান
কিন্তু তোমার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম না।

আশাভঙ্গের অভিশাপ নিয়ে জেগে উঠলাম।
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বইতে মুখ রেখে
অতগুলো কণ্ঠস্বরের মধ্যে
তোমার স্বরও কি আমি শুনতে পাইনি ?

...
(অনুবাদ: সুভাষ মুখোপাধ্যায়)

আমার বন্ধু নিরঞ্জন / ভাস্কর চৌধুরী

...

অনেক কথা বলবার আছে আমার
তবে সবার আগে নিরঞ্জনের কথা বলতে হবে আমাকে
নিরঞ্জন আমার বন্ধুর নাম, আর কোন নাম ছিল কি তার ?
আমি জানতাম না।
ওর একজন বান্ধবী ছিল অবশ্য কিছু দিনের জন্য
সে তাকে প্রীতম বলে ডাকত।

ওর বান্ধবীর নাম ছিল জয়লতা
নিরঞ্জন জয়লতা সম্পর্কে আমাকে কিছু বলেনি তেমন।
জয়লতাকে কখনো কোন চিঠি লিখেছিল কিনা
সে কথাও আমাকে সে বলেনি।
তবে জয়লতার চিঠি আমি দেখেছি
একটা চিঠি ছিল এরকম-
প্রীতম,
সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। তুমি বলেছ, এখন দুঃসময়-
কিন্তু আমি জানি, সবসময়ই সুসময়, যদি কেউ ব্যবহার করতে জানে তাকে
আমি বুঝি বেশী দিন নেই যদি পার এক্ষুনি তুলে নাও
নইলে অন্য পুরুষ ছিবড়ে খাবে আমাকে-

আমার ঘরে, বসে সিগারেট টানতে টানতে
নিরঞ্জন চিঠিটা চুপ করে এগিয়ে দিয়ে বলেছিল, বিভূ, চিঠিটা পড়ুন।

আমি প্রথমে পড়তে চাইনি।
পরে ওইটুকু পড়ে তার দিকে তাকিয়েছিলাম-
না-ওই সিগারেটের ধূয়োয়
আমি কোন নারী প্রেম-তাড়িত মানুষের ছায়া দেখিনি- ভয়ানক নির্বিকার।
কিছু বলছেন না যে ? আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম
কি বলবো ? এই ব্যাপারে।
কোন ব্যাপারে ?
এই যে জয়লতা।
বাদ দিন।

আমি বাদ দিয়েছিলাম।
নিরঞ্জন আমার ঘরে বসে অনেকক্ষণ সিগারেট
টেনে টেনে ঘরটাকে অন্ধকার করে চলে গিয়েছিল সেদিন।
জয়লতার সঙ্গে অন্য পুরুষের বিয়ে হয়েছিল
আমি জয়লতা এবং অন্য পুরুষটিকে দেখেছি বহুবার, বিশ্ববিদ্যালয়েই। জয়লতা আরো দেমাগী
আরো সুন্দরী হয়ে উঠেছিল।
অন্য পুরুষ ছিবড়ে খেলে মেয়েরা বুঝি
আরো সুন্দরী হতে থাকে ?

এ কথার সূত্রে সেদিন নিরঞ্জন আমাকে বলেছিল,
মানুষকে এত ক্ষুদ্রার্থে নেবেন না,
মানুষ এত বড় যে,
আপনি যদি ‘মানুষ’ শব্দটি
একবার উচ্চারণ করেন
যদি অন্তর থেকে করেন উচ্চারণ
যদি বোঝেন এবং উচ্চারণ করেন ‘মানুষ’
তো আপনি কাঁদবেন।
আমি মানুষের পক্ষে,
মানুষের সঙ্গে এবং মানুষের জন্যে।

হ্যাঁ, মানুষের মুক্তির জন্য
নিরঞ্জন মিছিল করতো।
আমি শুনেছি নিরঞ্জন বলছে...
তুমি দুস্কৃতি মারো, গেরিলা-তামিল মারো
এভাবে যেখানে যাকেই মারো না কেন
ইতিহাস লিখবে যে এত মানুষ মরেছে
বড়ই করুণ এবং বড়ই দুঃখজনক
শক্তির স্বপ্নে তুমি যারই মৃত্যু উল্লেখ করে
উল্লাস করনা কেন
মনে রেখো মানুষই মরেছে
এই ভয়ঙ্কর সত্য কথা নিরঞ্জন বলেছিল
মিছিলে হাত উঠিয়ে বলেছিল,
এভাবে মানুষ মারা চলবে না।
মানুষকে বাঁচতে দাও।

নিরঞ্জন আমার বন্ধু।
নিরঞ্জন বাঁচেনি।
তার উদ্যত হাতে লেগেছিল
মানুষের হাতে বানানো বন্দুকের গুলি।
বুকেও লেগেছিল- যেখান থেকে ‘মানুষ’ শব্দটি
বড় পবিত্রতায় বেরিয়ে আসতো।
সে লাশ-
আমার বন্ধু নিরঞ্জনের লাশ,
আমি দেখেছি
রক্তাক্ত ছিন্ন ভিন্ন লাশ,
মানুষ কাঁধে করে
তাকে বয়ে এনেছিল মানুষের কাছে।
জয়লতা সে লাশ দেখেছিল কিনা
সে প্রশ্ন উঠছে না।
দেখলেও যদি কেঁদে থাকে
সে প্রকাশ্যে অথবা গোপনে
তাতে নিরঞ্জনের কোন লাভ হয়নি।
মানুষ কেঁদেছিল
আমি জানি তাতে নিরঞ্জনের লাভ ছিল।
নিরঞ্জন প্রমাণ করতে পেরেছিল
গতকাল মিছিলে
আইন অমান্যের অভিযোগে
যে দুস্কৃতি মারা গিয়েছে
তার নাম নিরঞ্জন-
সে আসলে ‘মানুষ।’
...

আমি বাংলায় গান গাই / প্রতুল মুখোপাধ্যায়

...

আমি বাংলায় গান গাই,
আমি বাংলার গান গাই,
আমি আমার আমিকে চিরদিন এই
বাংলায় খুঁজে পাই।

আমি বাংলায় দেখি স্বপ্ন, আমি বাংলায় বাঁধি সুর-
আমি এই বাংলার মায়া ভরা পথে
হেঁটেছি এতটা দূর।

বাংলা আমার জীবনানন্দ
বাংলা প্রাণের সুখ
আমি একবার দেখি, বারবার দেখি
দেখি বাংলার মুখ।

আমি বাংলায় কথা কই,
আমি বাংলার কথা কই-
আমি বাংলায় ভাসি, বাংলায় হাসি,
বাংলায় জেগে রই।
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে
করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে ক্ষেপে গিয়ে
করি বাংলায় চিৎকার।

বাংলা আমার দৃপ্ত শ্লোগান,
ক্ষিপ্ত তীর-ধনুক
আমি একবার দেখি, বারবার দেখি
দেখি বাংলার মুখ।

আমি বাংলায় ভালোবাসি,
আমি বাংলাকে ভালোবাসি,
আমি তারই হাত ধরে সারা পৃথিবীর
মানুষের কাছে আসি।
আমি যা কিছু মহান বরণ করেছি
বিনম্র শ্রদ্ধায়,
মিশে তেরো নদী, সাত সাগরের জল
গঙ্গায়, পদ্মায়-
বাংলা আমার তৃষ্ণার জল
তৃপ্ত শেষ চুমুক
আমি একবার দেখি, বারবার দেখি
দেখি বাংলার মুখ।
...

আমিই সেই মেয়ে / শুভ দাশগুপ্ত

...

আমিই সেই মেয়ে।
বাসে ট্রেনে রাস্তায় আপনি যাকে রোজ দেখেন
যার শাড়ি, কপালের টিপ কানের দুল আর পায়ের গোড়ালি
আপনি রোজ দেখেন।
আর
আরও অনেক কিছু দেখতে পাবার স্বপ্ন দেখেন।
স্বপ্নে যাকে ইচ্ছে মতন দেখেন।
আমিই সেই মেয়ে।

বিহারের প্রত্যন্ত গ্রামে দিনের আলোয় যার ছায়া মাড়ানো
আপনার ধর্মে নিষিদ্ধ, আর রাতের গভীরে যাকে বস্তি থেকে
তুলে আনতে পাইক বরকন্দাজ পাঠান আপনি
আর সুসজ্জিত বিছানায় যার জন্য অপেক্ষায় অধীন হয়
আপনার রাজকীয় লাম্পট্য
আমিই সেই মেয়ে।

আমিই সেই মেয়ে- আসামের চাবাগানে ঝুপড়ি কামিন বস্তি থেকে
যাকে আপনি নিয়ে যেতে চান সাহেবি বাংলোয় মধ্যরাতে
ফায়ার প্লেসের ঝলসে ওঠা আলোয় মদির চোখে দেখতে চান
যার অনাবৃত শরীর
আমি সেই মেয়ে।

রাজস্থানের শুকনো উঠোন থেকে পিপাসার জল আনতে যাকে আপনি
পাঠিয়ে দেন দশ মাইল দূরে সরকারি ইঁদারায়- আর কুড়ি মাইল
হেঁটে কান্ত বিধ্বস্ত যে রমণী ঘড়া কাঁখে ঘরে ফিরলেই যাকে বসিয়ে দেন
চুলার আগুনের সামনে আপনার রুটি বানাতে
আমিই সেই মেয়ে।

আমিই সেই মেয়ে- যাকে নিয়ে আপনি মগ্ন হতে চান গঙ্গার ধারে কিংবা
ভিক্টোরিয়ার সবুজে কিংবা সিনেমা হলের নীল অন্ধকারে, যার
চোখে আপনি একে দিতে চান ঝুটা স্বপ্নের কাজল আর ফুরিয়ে যাওয়া
সিগারেটের প্যাকেটের মত যাকে পথের পাশে ছুঁড়ে ফেলে আপনার ফুল সাজানো
গাড়ি শুভবিবাহ সুসম্পন্ন করতে ছুটে যায় শহরের পথে-
কনে দেখা আলোর গোধুলিতে একা দাঁড়িয়ে থাকা
আমিই সেই মেয়ে।

আমিই সেই মেয়ে- এমন কি দেবতারাও যাকে ক্ষমা করেন না। অহংকার
আর শক্তির দম্ভে যার গর্ভে রেখে যান কুমারীর অপমান
আর চোখের জলে কুন্তী হয়ে নদীর জলে
বিসর্জন দিতে হয় কর্ণকে। আত্মজকে।
আমিই সেই মেয়ে।

সংসারে অসময়ের আমিই ভরসা।
আমার ছাত্র পড়ানো টাকায় মায়ের ওষুধ কেনা হয়।
আমার বাড়তি রোজগারে ভাইয়ের বই কেনা হয়।
আমার সমস্ত শরীর প্রবল বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে।
কালো আকাশ মাথায় নিয়ে
আমি ছাতা হয়ে থাকি।
ছাতার নিচে সুখে বাঁচে সংসার।

আপনি
আপনারা
আমার জন্য অনেক করেছেন।
সাহিত্যে কাব্যে শাস্ত্রে লোকাচারে আমাকে
মা বলে পুজো করেছেন।
প্রকৃতি বলে আদিখ্যেতা করেছেন- আর
শহর গঞ্জের কানাগলিতে
ঠোঁটে রঙ মাখিয়ে কুপি হাতে দাঁড় করিয়েও দিয়েছেন।
হ্যা, আমিই সেই মেয়ে।
একদিন হয়ত
হয়ত একদিন- হয়ত অন্য কোন এক দিন
আমার সমস্ত মিথ্যে পোশাক ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে
আমিই হয়ে উঠবো সেই অসামান্যা !
খোলা চুল মেঘের মত ঢাকবে আমার খোলা পিঠ।
দু চোখে জ্বলবে ভীষণ আগুন।
কপাল-ঠিকরে বেরুবে ভয়ঙ্কর তেজরশ্মি।
হাতে ঝলসে উঠবে সেই খড়গ।
দুপায়ের নুপুরে বেজে উঠবে রণদুন্দভি।
নৃশংস অট্টহাসিতে ভরে উঠবে আকাশ।
দেবতারাও আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে বলতে থাকবেন
মহামেঘপ্রভাং ঘোরাং মুক্তকেশীং চতুর্ভুজাং
কালিকাং দক্ষিণাং মুণ্ডমালা বিভুষিতাং।

বীভৎস দাবানলের মত
আমি এগোতে থাকবো ! আর আমার এগিয়ে যাবার পথের দুপাশে
মুণ্ডহীন অসংখ্য দেহ ছটফট করতে থাকবে-
সভ্যতার দেহ
প্রগতির দেহ-
উন্নতির দেহ-
সমাজের দেহ

হয়ত আমিই সেই মেয়ে ! হয়ত ! হয়ত বা।
...

নিঃসঙ্গতা / আবুল হাসান

...

অতটুকু চায়নি বালিকা !
অত শোভা, অত স্বাধীনতা !
চেয়েছিলো আরো কিছু কম,
আয়নার দাঁড়ে দেহ মেলে দিয়ে
বসে থাকা সবটা দুপুর, চেয়েছিলো
মা বকুক, বাবা তার বেদনা দেখুক !

অতটুকু চায়নি বালিকা !
অত হৈ রৈ লোক, অত ভীড়, অত সমাগম !
চেয়েছিলো আরো কিছু কম !
একটি জলের খনি
তাকে দিক তৃষ্ণা এখনি, চেয়েছিলো
একটি পুরুষ তাকে বলুক রমণী !
...

নেশা / মোফাজ্জল করিম

...

বাপজান আশা করি কুশলেই আছেন,
পরসমাচার এই যে,
সেদিন আপনি যে কাজটা করিলেন
তার জন্য এই পত্রটি না লিখিয়া পারিতেছিনা
দেখিতেছি যতই বয়স বাড়িতেছে, ততই আপনার কাণ্ডজ্ঞান
একে বারেই লোপ পাইতেছে।
আপনি কি করিয়া সেদিন আমার ড্রয়ইংরুমে,
অর্থাৎ বৈঠকখানায় বেমোক্কা ঠুকিয়া পড়িলেন,
বুঝিলামনা
সারাগায়ে ঘামের গন্ধ, ময়লা তেল চিপচিপে পাঞ্জাবী,
বগলে ছেঁড়া ছাতা, মাথায় চিতিপড়া কিস্তি টুপি,
যেনো আকবর বাদশার উর্নিশ আর কি।
হাতে মাটির হাড়ি, সর্বোপরি দু’পায়ের চামড়ার
কুচ কুচে কালো রং, বোধ হয় লজ্জায় ঢাকিয়া ফেলিবার
আশায়, রাস্তার সবটুকু ধুলি মাখাইয়া
পা দু’টিকে মনে হইতেছিলো চুনকাম করাইয়াছেন।
কি লজ্জা, আপনার ঐ মুর্তি দেখিয়া আমার বন্ধুগন
এবং তাদের সুন্দরী স্ত্রীরা, বজ্রাহতের মতো তাকাইয়া রহিলো।
যেনো তাহারা চাক্ষুস ভুত দেখিতেছে
আর আমার অবস্থাটা একবার ভাবিয়া দেখুন,
মান, সম্মান, মর্যাদা সব জাহান্নামে গেলো,
তাও-না হয়, আপনি যদি দয়া করিয়া একটু চুপ থাকিতেন
তবু একটা কথা ছিলো।
তা-না, আপনার আবার আহাল্লাদে মুখদিয়া
কথার ফোয়ারা ছুটিতে লাগিলোঃ
বাবা কেমোন আছো, বৌমা কোথায়,
বলিহারি ভাগ্যিস সেই মুহূর্তে ও সেখানে ছিলো না
থাকিলে সে বেচারির হার্ট এটাক হইয়া যাইতো,
সেতো আবার হঠাৎ কোনো খারাপ দৃশ্য
মোটেই সহ্য করিতে পারেনা,
বড় কোমল হৃদয়ের মানুষ কিনা।

বাপজান তোমাকে সাবধান করিয়া দিতেছি
আর যাই করো, এইভাবে আমাকে ডুবাইয়োনা
টাকা-পয়সা লাগিলে চিঠি দিও পারিলে পাঠাইবো,
আর অতো টাকা পয়সাও যে কেনো লাগে তোমাদের তাও বুঝি না।
তোমাদের আবার অতো খরচ কিসের
ক্লাবে যাওনা, পার্টি দাওনা
ইসুবগুল, আর চিরতার পানি ছাড়া
আরতো কোনো নেশাও কর না।

এইটুকু পড়িয়া দরিদ্র স্কুল মাস্টার
পিতা আনমনে বলিয়া উঠিলেন :
না, না, ভুল বললিরে বাবা
নেশা একটা আছে, বড় পুরোনো নেশা
কিছুতেই ছাড়তে পারিনা সেই নেশা
তোর জন্মের পর থেকে সারাক্ষণ তোকে দেখার নেশা
কিছুতেই ছাড়তে পারি না বাপ, কিছুতেই ছাড়তে পারি না।
...