Wednesday, May 19, 2010

হবুচন্দ্রের আইন / সুনির্মল বসু

...
হবুচন্দ্র রাজা বলেন গবুচন্দ্রে ডেকে--
"আইন জারী করে দিও রাজ্যেতে আজ থেকে,
                       মোর রাজ্যের ভিতর--
হোক্ না ধনী, হোক্ না গরীব, ভদ্র কিংবা ইতর,
কাঁদতে কেহ পারবে নাক, যতই মরুক শোকে--
হাসবে আমার যতেক প্রজা, হাসবে যত লোকে।
সান্ত্রী-সেপাই, প্যায়দা, পাইক ঘুরবে ছদ্মবেশে,
কাঁদলে কেহ, আনবে বেঁধে, শাস্তি হবে শেষে।"
                       বলে গবু- "হুজুর--
ভয় যদি কেউ পায় কখনো দৈত্য, দানা জুজুর,
কিম্বা যদি পিছলে পড়ে মুণ্ডু ফাটায় কেহ,
গাড়ীর তলে কারুর যদি থেঁতলিয়ে যায় দেহ;
কিম্বা যদি কোনো প্রজার কান দুটি যায় কাটা,
কিম্বা যদি পড়ে কারুর পিঠের ওপর ঝাঁটা;
সত্যিকারের বিপন্ন হয় যদি,
তবুও কি সবাই তারা হাসবে নিরবধি ?"
                      রাজা বলেন- "গবু-
আমার আইন সকল প্রজার মানতে হবে তবু।
কেউ যদি হয় খুন বা জখম, হাড্ডিতে ঘুণ ধরে,
পাঁজরা যদি ঝাঁঝরা হয়ে মজ্জা ঝরে পড়ে,
ঠ্যাংটি ভাঙে, হাতটি কাটে, ভুঁড়িটি যায় ফেঁসে,
অন্ধকারে স্কন্ধ কাটা ঘাড়টি ধরে ঠেসে,
কিম্বা যদি ধড়ের থেকে মুণ্ডুটি যায় উড়ে,
কাঁদতে কেহ পারবে নাক বিশ্রী বিকট সুরে।
                     হবুচন্দ্রের দেশে--
মরতে যদি হয় কখনো, মরতে হবে হেসে।"

পিটিয়ে দিলো ঢ্যাঁড়া গবু, রাজার আদেশ পেয়ে--
"কাঁদতে কেহ পারবে না আর, পুরুষ কিম্বা মেয়ে;
যতই শোকের কারণ ঘটুক হাসতে হবে তবু,
আদেশ দিলেন রাজাধিরাজ হবু;
রাজার আদেশ কেউ যদি যায় ভুলে,
                     চড়তে হবে শূলে।"

সেদিন হতে হবুর দেশে উল্টে গেল রীতি,
                     হররা-হাসির হট্টগোলে,
                     অট্টহাসির অট্টরোলে,
                     জাগলো তুফান নিতি।
হাসির যেন ঝড় বয়ে যায় রাজ্যখানি জুড়ে,
সবাই হাসে যখন তখন প্রাণ কাঁপানো সুরে।
প্যায়দা পাইক ছদ্মবেশে হদ্দ অবিরত,
                     সবাই হাসে আশে পাশে,
                     বিষম খেয়ে ভীষণ হাসে,
আস্তাবলে সহিস হাসে, আস্তাকুঁড়ে মেথর,
হাসছে যত মুমূর্ষরা হাসপাতালের ভেতর।
                     আইন জেনে সর্বনেশে
                     ঘাটের মড়া উঠছে হেসে,
বেতো-রোগী দেঁতো হাসি হাসছে বসে ঘরে;
কাশতে গিয়ে কেশো-বুড়ো হাসতে শুরু করে।
হাসছে দেশের ন্যাংলাফ্যাচাং হ্যাংলা হাঁদা যত,
গোমড়া উদো-নোংরা-ডেঁপো-চ্যাংরো শত শত;
                     কেউ কাঁদে না কান্না পেলেও,
                     কেউ কাঁদে না গাট্টা খেলেও,
পাঠশালাতে বেত্র খেয়ে ছাত্রদলে হাসে,
কান্না ভুলে শিশুর দলে হাসছে অনায়াসে।

রাজা হবু বলেন আবার গবুচন্দ্রে ডাকি,
"আমার আদেশ মেনে সবাই আমায় দিলে ফাঁকি ?
রাজ্যে আমার কাঁদার কথা সবাই গেল ভুলে,
                     কেউ গেল না শূলে ?
একটা লোকো পেলাম না এইবারে
                     শূলে চড়াই যারে।
                     নিয়ম আমার কড়া--
প্রতিদিনই একটি লোকের শূলেতে চাই চড়া।
যা হোক, আজই সাঁঝের আগে শূলে দেবার তরে--
যে করে হোক একটি মানুষ আনতে হবে ধরে।"

গবুচন্দ্র বল্লে হেসে চেয়ে রাজার মুখে,
"কাঁদতে পারে এমন মানুষ নাই যে এ মুল্লুকে;
আমি না হয় নিজেই কেঁদে আইন ভেঙে তবে
চড়ব শূলে, মহারাজের নিয়ম রক্ষা হবে।
কিন্তু একি, আমিও যে কাঁদতে গেছি ভুলে,
                     কেমন করে চড়ব তবে শূলে ?"
রাজা বলেন, "তোমার মত মূর্খ দেখি না-যে,
কাঁদতে তুমি ভুলে গেলে এই ক'দিনের মাঝে।
এই দ্যাখো না কাঁদে কেমন করে"--
এই না বলে হবু রাজা কেঁদে ফেল্লেন জোরে।

মন্ত্রী গবু বল্লে তখন, "এবার তবে রাজা--
নিজের আইন পালন করুন গ্রহণ করুন সাজা।"
বলেন হবু, "আমার হুকুম নড়বে না এক চুল,
আমার সাজা আমিই নেব তৈরি কর শূল !"
...

4 comments:

  1. ছোটবেলায় পড়েছিলাম।ইদানিং হবু চন্দ্রকে ভীষন মনে পড়ছে সেই সাথে কবিকেও।

    ReplyDelete